খেলাধুলা

বিশ্বকাপে আশা দিয়ে নিরাশায় ডোবালেন লিটন

‘অ্যান্ড লিটন দাস ইজ পেইন্টিং আ মোনালিসা হিয়ার!’ তার ব্যাটিং ইয়ান বিশপের চোখে এতোটাই মুগ্ধতা ছড়িয়েছিল যে মোনালিসা চিত্রকর্মের সঙ্গে তুলনা করতে বাধ্য করেছিল। মাধুর্যতা, সৌন্দর্য, গভীরতা মিলিয়ে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির অমর সৃষ্টি মোনালিসা। ২২ গজে লিটনের ব্যাটিং যেন বিশপকে মনে করিয়ে দিয়েছে সেই সৃষ্টি। কিন্তু সেই ক্যানভাস এখন ফ্যাকাসে। রংধনুর সাত রং নয়, ২২ গজের ক্যানভাস একেবারেই বিবর্ণ। 

দৃষ্টিনন্দন সব শটে যেখানে চোখ ধাঁধিয়ে দিতেন, ধ্রুপদী ব্যাটিংয়ে যেখানে বুঁদ করে রাখতেন, যেখানে বয়ে যেত চার-ছক্কার জোয়ার, সেখানে এখন পরাজয়ের মিছিল। আত্মহুতি দেয় একেকটি প্রতিশ্রুতিশীল ইনিংস। একেকটি বাজে শটে প্রতিপক্ষকে উইকেট উপহার দিয়ে আসা যেন নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। লম্বা সময় ধরে অফফর্মে থাকা এ ব্যাটসম্যান রানের ডানা মেলে উড়তে পারেননি বিশ্বকাপ মঞ্চেও। তাতে নিজের সামর্থ্যে যেমন সংশয় দেখা দিয়েছে। ঠিক তেমনি তার অফফর্মে ভুগেছে লাল-সবুজের ড্রেসিংরুমও। 

তামিম ইকবাল না থাকায় বিশ্বকাপে বাংলাদেশের উদ্বোধনী জুটি ছিল একেবারেই নামকাওয়াস্তে। লিটনের সঙ্গী তানজিদ হাসান তামিম। ওপেনিং জুটিতে রান এলে ভালো, না হলে নেই; এমন ভাবনাতে টিম ম্যানেজমেন্ট তৃতীয় ওপেনারও নেয়নি। চার বছর আগে আরেকটি বিশ্বকাপ খেলায় এই মঞ্চের রোমাঞ্চ, উত্তেজনা সব তার জানা। তাই কাঁধে দায়িত্বটাও ছিল বেশি। কিন্তু লিটন ছায়া হয়ে থাকালেন টুর্নামেন্ট জুড়েই। 

৯ ম্যাচে রান ২৮৪। যেখানে গড় রান ৩১.৫৫। অথচ ২০১৯ সালে ৫ ম্যাচে ১৮৪ রান করে ব্যাটিং গড় ছিল ৪৬.০০। গড়ের এমন বিশাল পার্থক্য স্পষ্ট বলে দেয় ব্যাটিংয়ে কতটা নিষ্প্রভ ছিলেন ডানহাতি ব্যাটসম্যান। টুর্নামেন্ট জুড়ে যেখানে ওপেনাররা প্রাধান্য বিস্তার করেছে সেখানে লিটন প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ। ৯ ইনিংসে চারটিতে ভালো শুরুর পর নিজের উইকেট উপহার দিয়ে এসেছেন। দুই ইনিংসে দুই অঙ্ক ছোঁয়ার আগে ড্রেসিংরুমে। 

নিউ জিল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে তার আউটের ধরণ দেখে কেউ কেউ প্রশ্নও তুলেছেন তার নিবেদনের ঘাটতি নিয়ে। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলা ইনিংসের প্রথম বলে ডাউন দ্য উইকেটে গিয়ে ক্যাচ দেন ডিপ ফাইন লেগে এবং নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে রিভার্স সুইপ খেলেন ইনিংসের শুরুর দিকে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তার ২৩ রানে ফিরে আসাটাই ছিল বোলারের পূর্ণ ক্রেডিট। মাদুশাঙ্কার ইয়র্কার তার পায়ের পাতায় আঘাত করলে এলবিডব্লিউ হন। এছাড়া বাকি আটটি ইনিংসে চাইলেই লিটন তার ইনিংস লম্বা করতে পারতেন। থিতু হওয়া ইনিংসগুলো দীর্ঘ করতে পারতেন ম্যাজিকাল ব্যাটিংয়ে। 

ইংল্যান্ড, ভারত, পাকিস্তান ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তার রান যথাক্রমে ৭৬, ৬৬, ৪৫ ও ৩৬। এই চার ইনিংসে যে সময়ে লিটন আউট হয়েছেন সেখানে প্রতিষ্ঠিত কোনো ওপেনার থাকলে চারটি সেঞ্চুরি তুলে নিতেন। তেমনটাই তো হয়েছে। রান তোলায় ওপেনিংয়ে শীর্ষস্থানে যারা রয়েছেন; কুইন্টন ডি কক, রাচিন রবীন্দ্র, ডেভিড ওয়ার্নার, রোহিত শর্মা ও ডেভিড মালান প্রত্যেকেই অন্তত একটি করে সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছেন গ্রুপ পর্বের ম্যাচগুলোতে। আরো ভেঙে বললে, ডি কক চারটি, রাচীন তিনটি ও ওয়ার্নার দুটি সেঞ্চুরি পেয়েছেন। বাকিরা দুটি করে। সেখানে বাংলাদেশের লিটনের নেই কোনো তিন অঙ্কের ইনিংস। এজন্য নিজেকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারেন লিটন। 

বড় মঞ্চে নিজেকে মেলে ধরার তাড়না, নিবেদনে ঘাটতি ফুটে উঠেছে। যে স্ট্রাইক রেট নিয়ে এতো আলোচনা, সমালোচনা; সেখানে লিটনের স্ট্রাইক রেট ৮০.২২। নামের পাশে ৭৬ ও ৬৬ রানের দুটি ইনিংস যা আদতে কোনো কাজেই আসেনি। ধর্মশালায় ইংল্যান্ডের বিপক্ষে যখন ৭৬ রানে আউট হন তখনও ইনিংসের বাকি প্রায় ৩০ ওভার। পুনেতে ভারতের বিপক্ষে ৬৬ রানে আউট হন তখন ইনিংসের ২৭.৪ ওভার। অথচ এই ইনিংসগুলোকে কত বড় করা যেত বলে আফসোস করছিলেন দলের টিম ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদ সুজন,‘ও যেই ইনিংসগুলোকে বড় করেছিল সেখানে থেকে অন্যান্য ব্যাটসম্যানরা উড়তে থাকে। একশর পর দেড়শতে চলে যায়। সেখানে লিটন থেমে থাকে নিজের গড় রানের আশেপাশে।’

লিটনের খেলায় পুরো মনোযোগ ছিল কিনা সেটা নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। বিশ্বকাপ চলাকালীন দেশে ফিরেছেন দুইবার। পারিবারিক কারণে টিম ম্যানেজমেন্ট থেকে ছুটি নিয়ে দেশে ফিরলেও তা খুব ভালোভাবে নেয়নি বিসিবি। সঙ্গে অনুশীলনের ঘাটতি, ভ্রমণের ঝাক্কিতে শতভাগ ফিটনেস ছিল কিনা সেসব কথাও উঠছে আলোচনার টেবিলে। কেননা তা আউটের ধরনগুলো যেন তালগোল পাকানো। যা বিশ্বাস করতে পারেন না খালেদ মাহমুদও, ‘ও যদি একটা ভালো বলে আউট হয় তাহলে খারাপ বলে আউট হয় তিন থেকে চারবার। ঘুরে ফিরে এমন হয়ে আসছে।  যা আসলে ওকে আরো ভুগিয়েছে।’

লিটনের মতো একই অবস্থা দলের বাকিদেরও। তাইতো সহ অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত সতীর্থকে আগলে রাখার চেষ্টায় ছিলেন,‘ব্যাক্তিগতভাবে কোন খেলোয়াড়কে নিয়ে কথা বলতে আমি পছন্দ করি না। আমার মনে হয় দল হিসেবেই আমরা ভালো করিনি। টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানদের সুযোগ বেশি ছিল। উপরের থেকে যদি স্কোরটা বেশি বড় হতো, তাহলে মনে হয় দল আরো ভালো অবস্থানে থাকতো। আশা করবো সামনে ইনিংসগুলো বড় হবে। তবে ব্যক্তিগতভাবে কাউকে নিয়ে কিছু বলতে চাই না।’

ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ খেলতে এসে লিটন নিজের ছায়া হয়ে থাকবেন তা ভাবতে পারেননি অনেকেই। তবে লম্বা সময় ধরেই লিটন বড় ইনিংস খেলতে পারছেন না ওয়ানডে ক্রিকেটে। ৩৬ ইনিংস আগে পেয়েছেন শেষ সেঞ্চুরি। লম্বা বিরতিতে তার ব্যাট থেকে ফিফটি রানের ইনিংস এসেছে নয়টি। বিশ্বকাপ মঞ্চে যাবার আগে এমন অফফর্মে থাকা ব্যাটসম্যানকে নিয়ে হইচই ছিল প্রবলভাবে। বিশ্বকাপ ভরাডুবিতে লিটন সেই আলোচনা, সমর্থন এখন ক্ষোভে পরিণত হয়েছে।