‘টেস্ট ক্রিকেট খেলেছি, খেলাটির প্রতি ভালোবাসার কারণে এই সংস্করণের মৃত্যু আমি দেখতে চাই না। আশা করছি, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের বাইরে গিয়ে আমরা ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পাকিস্তান, নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকায় এর গুরুত্ব ফিরিয়ে আনতে পারবো।’
কথাগুলো যিনি বলেছেন, তাকে বলা হয় ক্রিকেটের ‘বরপুত্র’, ব্রায়ান চার্লস লারা নামেই যাকে আমরা চিনি। শচীন টেন্ডুলকারের স্ট্রেইট ড্রাইভ যদি হয় ক্রিকেটের ক্যানভাসে নিপুণ দক্ষতার আঁচড়, ব্যাট নাচিয়ে লারার হাঁকানো কভার ড্রাইভ দুর্দান্ত ফিনিশিং। অথচ সেই লারার কন্ঠেই টেস্ট ক্রিকেটকে বাঁচানোর আর্তনাদ!
চারদিকে টি-টোয়েন্টির তুমুল বাজনা। অর্থ-বিত্তের প্রভাব আর সাময়িক বিনোদনের কারণে সেই বাজনার ঝনঝনানি দিনকে দিন বেড়েই চলছে। সেই সঙ্গে লারা-শচীনদের কণ্ঠে টেস্ট ক্রিকেটকে বাঁচানোর আকুতি করুণ থেকে করুণতর হচ্ছে। স্টিভ ওয়াহ থেকে শুরু করে হাল আমলের জেসন হোল্ডারের কণ্ঠেও আশঙ্কার সুর, ‘টেস্ট ক্রিকেটের মৃত্যু আসন্ন।’
চাইলেই কি সাদা পোশাকের ঐতিহ্য বিলীন করে দেওয়া যাবে? ১৪৭ বছরের ঐতিহ্যের ভার ক্রিকেট বয়ে নিয়ে চলবে আজীবন। নয়তো শামার জোসেফ নামক অখ্যাত এক তরুণ কেন সাদা পোশাকের দ্যুতিতে মাতিয়ে তুলবেন ‘গতির স্বর্গ্য’ গ্যাবা? টম হার্টলি কেন এতোটা ‘হার্টলেস’ হয়ে ছোবল দেবেন ভারতের রাজত্বে? ওলি পোপ কেন দিনভর মাটি কামড়ে পড়ে থাকবেন? উত্তর একটাই, সাদা পোশাকের দ্যুতি চিরকালীন উজ্জ্বল।
২৮ জানুয়ারি ২০২৪, ক্রিকেটের ইতিহাসে দিনটি অন্যভাবেই হয়তো জায়গা করে নেবে। বিশ্বজুড়ে টেস্ট ক্রিকেটের মৃত্যু যখন সবাই দেখে ফেলছে, ঠিক তখনই যেন পুনরুত্থান হলো ক্রিকেট ঐতিহ্যের এই সংস্করণের। নব জাগরণের গান নিয়ে হাজির হলেন দুজন। প্রথমটি নামটি জোসেফ, দ্বিতীয়টি হার্টলি। দুজন লিখলেন টেস্ট ইতিহাসের অন্যতম স্মরণীয় গাঁথা।
গ্যাবার এক সোনালী সন্ধ্যা। ২৭ বছর পর অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টেস্ট জয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজের জন্য ব্যাপারটা আনন্দের চেয়েও বেশি বিস্ময়ের। রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ের পর ৮ রানের এমন জয়ে অশ্রুসিক্ত হতে বাধ্য হন কিংবদন্তি ব্রায়ান লারা, কার্ল হুপার, ইয়ান বিশপসহ অজস্র সমর্থকেরাও। এ তো টেস্ট ক্রিকেটের পুনরুত্থানের ‘আনন্দাশ্রু’ও। লারা যেমনটি চেয়েছিলেন।
ব্রিসবেন থেকে হায়দরাবাদ; অঙ্কের হিসেবে দূরত্ব ৯ হাজার ৪৪৩ কিলোমিটার। জোসেফের দিনে এই দূরত্বটাই শূন্যতে নিয়ে আসলেন হার্টলি নামের অখ্যাত এক অজি স্পিনার। জোসেফ রূপকথা ফিরে আসলো হায়দরাবাদে। ওলি পোপের মহাকাব্যিক ১৯৬ রানের ইনিংসটি ম্লান করে সব আলো নিজের দিকে কেড়ে নেন হার্টলি। তার ঘূর্ণি বিষে নীল হয়ে ২৩১ রান তাড়ায় নেমে ২০২ রানেই শেষ ভারতের ইনিংস! ইংল্যান্ডের জয় ২৮ রানে, হার্টলির শিকার ৭ উইকেট।
ম্যাচশেষে ইংল্যান্ড বেন স্টোকসের ভাষায়, ‘নিঃসন্দেহে সেরা জয়’। ক্রিকেটের জন্মদাতা দেশের একজন যখন সেরা জয় বলেন, মৃত্যুর দিনক্ষণ গুণতে থাকা টেস্ট ক্রিকেট তখন আরও দ্যুতিময় হয়ে ওঠে। গায়ানার গহীন জঙ্গলের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা এক নাইটগার্ড জোসেফ হয়ে ওঠেন টেস্ট ক্রিকেটের গার্ড, পোপ-হার্টলিরা হয়ে ওঠেন তার সঙ্গী। সাদা পোশাকের ঐতিহ্যের দ্যুতি বিলীন করে সাধ্যি কার?
কেভিন পিটারসেনের মতো করে বলতেই হয়, ‘টেস্ট ক্রিকেটে, তুমি একেবারে নিখুঁত সৌন্দর্য্য।’ ঠিক শচীনের স্ট্রেইট ড্রাইভ আর লারার কাভার ড্রাইভের মিশেলে অনুপম সৃষ্টির মতো বেঁচে থাকো যুগ-যুগান্তর।