চোখের সমস্যায় সাকিব আল হাসান ভুগছেন ও সংগ্রাম করছেন তা পুরোনো খবর। এজন্য বিসিবি চেয়েছিল সাকিবকে খোলা মনে চিকিৎসা, সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুলতে। কিন্তু বাঁধ সেধেছে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল)।
চোখের এক্সট্রাফভয়াল সিএসআর রোগ ধরা পড়ার পরও সাকিব চালিয়ে যাচ্ছেন বিপিএল। ব্যাটিংয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে বিধায় ২২ গজে নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছেন। ম্যাচের ফাঁকে ফাঁকে ব্যাটিংয়ের জড়তা কাটাতে কাজও করেছেন। গতকাল সিলেটে তিন ম্যাচ পর উপরের দিকে ব্যাটিংয়ে ফেরেন।
গোল্ডেন ডাক পাওয়ায় সাকিবের চোখের সমস্যা নিয়ে আলোচনা আরো বেড়ে গেছে। তবে বোলিংয়ে সাকিব সেরা অবস্থানেই আছেন। ৪ ওভারে ১৮ রানে পেয়েছেন ২ উইকেট।
ম্যাচ শেষে সাকিব দলের প্রতিনিধি হয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসেছিলেন। ৮ মিনিট ২৬ সেকেন্ডের সংবাদ সম্মেলনে ৬ মিনিট চোখের সমস্যা নিয়েই কথা বলতে হয়েছে তাকে। তার কথা শুনেছে রাইজিংবিডিও। সাকিবের কথাগুলো হুবহু তুলে ধরা হলো।
কেমন আছেন? সাকিব আল হাসান: ভালো আছি, আলহামদুলিল্লাহ।
চোখের কন্ডিশনটা কেমন? সাকিব আল হাসান: ভালো আছে।
ব্যাটিংয়ে আপনার একটু সমস্যা হচ্ছিল। এখন কি একটু কমফোর্ট জোনে ফিরেছেন? সাকিব আল হাসান: আপনাকে কে বলেছে চোখের জন্য ব্যাটিংয়ে সমস্যা হচ্ছে।
সোহান শেষ ম্যাচের পর বলেছিলেন, সাকিব ভাইকে অনুরোধ করবো সে যেন সংবাদ সম্মেলনে আসেন… সাকিব আল হাসান: অনুরোধ করেনি…অধিনায়ক অর্ডার দিয়েছে। আমি চলে এসেছি।
সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে যদি বলেন, শেষ দুই ম্যাচে ব্যাটিংয়ে নামেননি। এখন কি একটু কমফোর্ট বেড়েছে? সাকিব আল হাসান: এটা বলা মুশকিল। রান যত করবো তত কমফোর্ট লেভেলটা বাড়বে। রান যতক্ষণ না করছি ওই ছন্দটাও আসবে না। কমফোর্ট জোনটাও থাকবে না এটা খুব স্বাভাবিক।
হতাশা আছে নাকি রান করতে না পারার? সাকিব আল হাসান: না।
আজ নামলেন। প্রথম বলে আউট হলেন। রিভিউ নিতে গিয়ে টাইমটাও চলে গেল। পরে দেখলেন আউট ছিল না…খারাপ লাগা কাজ করেছিল কিনা? সাকিব আল হাসান: বুঝলাম যে খারাপ টাইমে সব কিছু খারাপ যায় (হাসি) ।
কোচ সালাউদ্দিন বলেছেন, আপনি যদি ব্যাটিংয়ে ফিরতে না পারেন তাহলে ক্রিকেট ছেড়ে দেবেন…আপনি আসলে কি ভাবছেন? সাকিব আল হাসান: আমার এখন পর্যন্ত কোনো ভাবনা নেই। চেষ্টা করছি। চেষ্টা শেষ করে নিই। তারপর পরেরটা পরে ভাববো।
আপনি একজন অলরাউন্ডার। কিন্তু শেষ কয়েকটি ম্যাচে শুধু বোলিংটাই করলেন। অলরাউন্ডার হিসেবে কতটা কঠিন অবদান রাখা… সাকিব আল হাসান: জিনিসটা হচ্ছে, জীবনে কখনো করতে হয়নি এরকম কিছু। একটা দিক থেকে খেলতে হয়েছে। প্রথমবার। অবশ্যই রংপুর রাইডার্সের জন্য আমার ফিল হচ্ছে। তারা যে প্রত্যাশা নিয়ে আমাকে দলে নিয়েছিল তার অর্ধেক আমি করতে পারছি। অর্ধেক পারছি না।
তারা তারপরও আমাকে যে সাপোর্ট দিয়েছে সেজন্য ধন্যবাদ দিতে হয়। এরকম একটা ফ্রাঞ্চাইজিতে খেলতে পেরে গর্বিত আমি বলবো। তারা আমাকে এই সময়ে যে টেক কেয়ার করেছে, আমার পরিস্থিতিটা যেভাবে বুঝেছে, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা ছাড়া আমার কিছু বলার নেই।
জাতীয় দলে খেলা নিয়ে চিন্তা করছেন? সাকিব আল হাসান: এটা আসলে সময়ই বলে দেবে। টুর্নামেন্ট এখনো আছে। দেখি কি অবস্থা দাঁড়ায়। আর অফিসিয়ালদের সাথেও বসতে হবে। তারপর সিদ্ধান্ত হবে।
চোখের বর্তমান যে অবস্থা তাতে কতটা আত্মবিশ্বাসী যে ব্যাটিংটা আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়া যাবে? সাকিব আল হাসান: আমার ধারনা নেই, এটা কখন ঠিক হবার সম্ভাবনা আছে। আর বারবার চোখ, চোখ, চোখ বলছেন; চোখের কোনো সমস্যা নেই। আপনি চশমা পরে যেটা দেখেন, আমি চশমা না পরে সেটার থেকে ভালো দেখি। ওই টেস্টে কোনো সমস্যা নেই। কি সমস্যা আছে সেটা খোঁজার চেষ্টা করছি এখনও।
সিঙ্গাপুরেও কি পাননি সমস্যা খুঁজে? সাকিব আল হাসান: সিঙ্গাপুরে তো চোখ দেখিয়েছি, শরীর দেখিয়েছি…
সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে তাহলে? সাকিব আল হাসান: এটা আমিও খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি, সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে। বাকিরাও চেষ্টা করছে।
বলা হচ্ছে, চাপের কারণে এটায় সমস্যা হচ্ছে। মানসিক সমস্যা থেকে হতে পারে বলা হচ্ছে। একজন বিজ্ঞ চিকিৎসকের মত নেওয়া হয়েছিল… সাকিব আল হাসান: উনি তো আমাকে দেখেননি। রিপোর্টও দেখেনি। আমাকে নিয়ে বলাটা উনার মুশকিল।
বিসিবির অফিসিয়াল বিবৃতিতে ছিল, একটি রক্ষণশীল পদ্ধতি অবলম্বন করে আপনার চিকিৎসা করা হবে…কিন্তু আপনি খেলার কারণে চাপ বেড়ে যাচ্ছে কিনা? সাকিব আল হাসান: বেড়ে যাচ্ছে কিনা…মাঝে মধ্যে আমিও প্রশ্ন করি, এটা করলে বেড়ে যাচ্ছে কিনা। নাকি এটা করা ঠিক হবে। এখন এটা কিভাবে ফাইন্ড আউট করবো। আপনি বলেন তো কিভাবে করা উচিত। আমি কনফিউজড। আপনি চেষ্টা করে ঘরে বসে থাকলেন…তারপর দেখলেন কাজ হলো না। তখন বলবেন, চেষ্টাই করলাম না।
যেহেতু ব্যাটিং করতে পারছেন না। বোলিংয়ে বাড়তি চাপ বা অনুপ্রেরণা কাজ করছে কিনা? সাকিব আল হাসান: এই উইকেটে সব স্পিনার ভালো করছে। যে বল করে সে-ই। আমি যদি বেশি খারাপ করি তাহলে দেখতেও তো খারাপ লাগে। তাই একটু ভালো করার চেষ্টা করছি। তানভীর কালকে ৪ উইকেট পেল। আজ তাইজুল ভালো বল করেছে। আমাদের শেখ মেহেদী ভালো বল করেছে। নবীও ভালো বল করেছে। আমি যদি খারাপ করি দেখতে কেমন লাগে না। একটা রেপুটেশন তো আছে। তাই একটু চেষ্টা করছি ভালো করার।
সাকিবের আনন্দমাখা সংবাদ সম্মেলন শেষ হয়। যার রেশ থেকে যায় আরো লম্বা সময়। উপস্থিত কেউ মনে করে বলতে পারলেন না, সাকিব এতোটা চনমনে, মুখে এক গাল হাসি নিয়ে শেষ কবে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। সচরাচর তাকে এমন পাওয়া যায় না। অথচ এই হাসিমাখা সংবাদ সম্মেলনের আড়ালেও যে সাকিব অন্য রকম এক সংগ্রাম করে যাচ্ছেন নিজের সঙ্গে।
চোখের সমস্যা নিয়ে ভরা মজলিশে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য করেননি তা অনুমান করতে পেরেছেন অনেকেই। এজন্য বারবার প্রসঙ্গ উঠলেও এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন, কী সমস্যা হচ্ছে সেটা এখনও খুঁজে পাননি সেই উত্তরও দিয়েছেন। অথচ পাঁচ দেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখিয়ে সাকিব নিশ্চিত হয়েছেন, বাম চোখে রেটিনার সমস্যা ধরা পড়েছে। নানাবিধ পরীক্ষার পর জানা গেছে, এক্সট্রাফভয়াল সিএসআর রোগে ভুগছেন। রোগটির নাম সেন্ট্রাল সেরাস রেটিনোপ্যাথি। সেন্ট্রাল সেরাস রেটিনোপ্যাথি হলো চোখের একটি অবস্থান, যেখানে রেটিনার পেছনে তরল জমা হয় এবং দৃষ্টিকে প্রভাবিত করে।
চোখের এই সমস্যার সঙ্গে পারফরম্যান্সও যে তার সংগ্রামের বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে তা সাকিব নিজের কথাতেই বুঝিয়েছেন। ব্যাটিংয়ে অবদান রাখতে পারছেন না বলে বোলিংয়ে বাড়তি তাগিদ অনুভব করছেন। সেজন্য শুধু আঁটসাঁট বোলিংই নয়, দলের কাজে লাগে এমন কিছু করার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন। অধিনায়কত্ব না করলেও সিনিয়র ক্রিকেটার হিসেবে যেটুকু দায়িত্ব রয়েছে সেটাও করতে দেখা যাচ্ছে তাকে। বিশেষ করে অধিনায়ক সোহানকে পূর্ণ সহযোগিতা করে তার পেছনে ছায়া হয়ে আছেন।
লম্বা ক্যারিয়ারে সাকিবের পারফরম্যান্স যখনই খারাপ গেছে তখনই এমন কিছু করেছেন যা দিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চ নিজের করে নিয়েছেন। পরবর্তীতে সেই ধারাবাহ্তিা ধরে রেখে সব সমালোচনার জবাব দিয়েছেন। বিপিএল তার বোলিং তেমন ফিরে আসার জয়গানই গাইছে। তাই তো মাঠে নামলে সাকিবের উদ্দেশ্যে যে ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান ওঠে, ভালো বোলিংয়ের পর সাকিব ফিরতি পথে ‘ভুয়া ভুয়া’ বললে গ্যলারিতে ‘সাকিব সাকিব’ কলরব উঠে। মুখে হাসি নিয়ে সাকিব নিজের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। সামনে কেবল তার সুদিনের অপেক্ষা।