প্রায় ১০ দিন ধরে লক্ষ্মীপুরের পাঁচ উপজেলার ৯০ শতাংশ মানুষ পানিবন্দি। জেলার বেশির ভাগ জমি পানিতে তলিয়ে থাকায় বিভিন্ন ধরনের ফসল নষ্ট হয়েছে। মাছের ঘেরও প্লাবিত হয়েছে। গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন বন্যাদুর্গতরা। এ ক্ষতি পোষাতে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে বলে মনে করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
এদিকে, খাল-বিলে প্রতিবন্ধকতা থাকায় পানিপ্রবাহ কম হচ্ছে। বন্যার পানি দ্রুত নামতে না পারলে জলবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে দুর্ভোগ আরও বাড়তে পারে বলেও শঙ্কার কথা জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার দিঘলী ইউনিয়নের কৃষক নূর মোহাম্মদ। ৮-৯ লাখ টাকা খরচ করে নতুন ঘর তৈরি করেছিলেন তিনি। বন্যায় তার ঘরের উত্তর পাশের দেয়াল ভেঙে গেছে। এছাড়া, বন্যার আগে টানা বৃষ্টিতে তার আমন ধানের খেত নষ্ট হয়েছে। ঋণের টাকায় চারটি পুকুরে মাছ চাষ করেছিলেন। বন্যার পানিতে সব পুকুরের মাছও ভেসে গেছে এই কৃষকের।
নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘ত্রাণে এক বেলা পেটের ক্ষুধা মিটলেও কষ্ট মিটবে না। তিল তিল করে গড়া সংসার বানের (বন্যা) জলে ভেসে যাওয়ার দৃশ্য নিজ চোখে দেখেছি। ঘুরে যে দাঁড়াব-সে জোগানও নেই আমার।’ বন্যার পানিতে তলিয়ে থাকা ঘরের এক কোণে ১০ মাসের শিশুকে নিয়ে বসে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন তিনি। পাশেই ছিলেন তার স্ত্রী আশা বেগম।
নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘বন্যায় আমার সব শেষ। এ বছর ৮-৯ লাখ টাকা খরচ করে নতুন ঘর করেছি। এখন আর কিছুই নেই আমার।’
গত ২২ আগস্ট রাতে নোয়াখালী থেকে বন্যার পানির চাপ বাড়তে থাকে লক্ষ্মীপুরে। শুধু কৃষক নূর মোহাম্মদ বা তার প্রতিবেশীরাই নন, বন্যায় জেলার প্রায় ১০ লাখ মানুষ পানিবন্দি। এর মধ্যে ৩০ হাজার পরিবার সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পেরেছেন। অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন অন্যের বাড়ির ছাদে। চোর-ডাকাতের ভয়ে অনেকে নিজের বাড়িতেই থেকে গেছেন। পানি থাকায় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন এসব মানুষরা।
বন্যা পরিস্থিতির তেমন উন্নতি না হওয়ায় গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ কাঁচা বাড়ি হেলে পড়তে শুরু করেছে। অনেকেই হেলে পড়া ঘর বাঁশ ও কাঠের খুঁটি দিয়ে কোনোমতে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন।
গুপিরখিল গ্রামের বেল্লাল উদ্দিন বলেন, ‘একচালা ঘরের ভেতরেই কোমর পানিতে সব আসবাবপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। ঘরটির নিচের মাটি নরম হয়ে যাওয়ায় পূর্ব দিকে হেলে রয়েছে। পাশ থেকে পাঁচটি খুঁটি দেওয়ায় এখন পর্যন্ত ঘরটি দাঁড়িয়ে আছে। কোমর পানিতে আর কতদিন টিকে থাকবে ঘরটি?’ পরিবারের সদস্যদের স্বজনদের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। প্রতিদিন দুই বার করে ঘরটি দেখতে আসি।’
বন্যার পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকায় পর্যাপ্ত খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। গত দুই-তিনদিন ধরে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে ত্রাণ নিয়ে স্বেচ্ছাসেবীরা এলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে তারা পৌঁছাতে পারছেন না। আশ্রয়কেন্দ্রে খাবার থাকলেও ঘরে থাকা পানিবন্দি মানুষগুলো রয়েছেন অনাহারে।
গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ধীর গতিতে বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। তবে, কোথাও কোথাও এক বা দুই ইঞ্চি করে পানি কমছে। পানিপ্রবাহের খালগুলোয় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়ায় যেভাবে পানি নামার কথা সেভাবে নামছে না। ফলে দীর্ঘমেয়াদি জলাবদ্ধতার কবলে থাকতে হবে এ অঞ্চলের মানুষকে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
তারা বলছেন, রহমতখালী খাল, ওয়াবদা খাল,ডাকাতিয়া খাল, রামগঞ্জ উপজেলার বিরেন্দ্র খাল, কমলনগর ও রামগতি উপজেলার বুলুয়া খাল হয়ে মূলত মেঘনায় প্রবাহিত হয় পানি। কিন্তু দীর্ঘদিন থেকে প্রভাবশালী মহলের কবলে খালগুলোর বিভিন্ন অংশ দখল হয়ে যায়। তাছাড়া দীর্ঘদিন সংস্কারের অভাবে খালগুলোর বিভিন্ন অংশে ময়লা-আবর্জনা ও কচুরিপানা জমে পানির গতিপ্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। তাই বন্যার পানিও এসব খাল দিয়ে নামতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ উজ জামান বলেন, ‘বন্যার পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। বৃহস্পতিবার পানির উচ্চতা ১০ সেন্টিমিটার কমেছে। মেঘনা নদীর পানি অনেক নিচে রয়েছে। খাল দিয়ে ঠিকমতো পানি নামতে পারছে না। বৃষ্টি না হলে এবং বন্যাকবলিত পাশের জেলা থেকে পানি না এলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।’
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফুর রহমান বলেন, ‘এখনো অনেক মানুষ পানিবন্দি। ক্ষতির পরিমাণও ব্যাপক। বন্যার্তদের খাবারসহ সব ধরনের সহযোগিতা করে যাচ্ছে প্রশাসন। ক্ষতিগ্রস্তদের আরো সহায়তা দিতে মাঠ পর্যায়ে কাজ করা হচ্ছে।’
এদিকে, গবাদিপশু নিয়েও বিপাকে পড়েছেন খামারিরা। গো-খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। বন্যার পানিতে খড় পচে যাচ্ছে। নিরাপদ আশ্রয় এবং নিরাপত্তার অভাব দেখা দিয়েছে। রাখার জায়গা না থাকায় কেউ কেউ পশু আশ্রয়কেন্দ্রে রেখেছেন। অনেকে ভবনের ছাদেও গবাদি পশু রাখছেন।
জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, লক্ষ্মীপুরের পাঁচটি উপজেলার ১৩ হাজার ৭০০ একর চারণভূমি প্লাবিত হয়েছে। বন্যায় মারা গেছে ১৮টি গরু, ৫২টি ছাগল ও ১৫টি ভেড়া, ১ লাখ ৫১ হাজার মুরগি ও ৯৭৩টি হাঁস। সব মিলিয়ে পশু সম্পদের ক্ষতি হয়েছে ৬ কোটি ৪১ লাখ ৫৮ হাজার ৫০০ টাকা। এছাড়া ২ কোটি ৮৬ লাখ ৭ হাজার ৫০০ টাকার খড়, ৭ কোটি ৭১ হাজার ২০০ টাকার দানাদার খাদ্য, ৩ কোটি ৭০ লাখ টাকার ঘাস নষ্ট হয়েছে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. কুমুধ রঞ্জন মিত্র বলেন, ‘প্রথম দিকে কিছুটা ঝুঁকি ছিল। আমরা সার্বক্ষণিক তদারকি করেছি। আপাতত গবাদিপশুর তেমন কোনো ঝুঁকি নেই। আমরা উপজেলা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখছি। গো-খাদ্যের কিছুটা সংকট রয়েছে। এ অবস্থায় প্রত্যেক উপজেলায় ১ লাখ টাকা করে বরাদ্দ বিতরণ করা হয়েছে। ক্ষতির তালিকা পাঠানো হয়েছে। আরো বরাদ্দ এলে চাষি ও খামারিদের মধ্যে তা বিতরণ করা হবে।’