খেলাধুলা

অপ্রতিরোধ্য বাংলাদেশ, বিজয় দেখলো বিশ্ব

‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর, ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখীর ঝড়, তোরা সব জয়ধ্বনি কর’- কাজী নজরুল ইসলামের অমর কবিতার মতোই জয়ধ্বনি করে ফেললো বাংলাদেশ। ইতিহাসের অমর পাতায় অক্ষয় কালিতে নিজেদের নাম লিখে ফেললো নাজমুল হোসেন শান্তর দল।

নির্ভয়ে, নির্ভারে, বুক চিতিয়ে লড়াই করে, চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞায় অপ্রতিরোধ্য পারফরম্যান্সের ছবি এঁকে এবার সিরিজ জয়ের অমূল্য স্বাদ পেল বাংলাদেশ। যেখানে পাকিস্তান দূর্গ জয় করার চিন্তাও ছিল দূর আকাশের তারা হাতে পাওয়ার মতো, সেখানে তাদেরকে ধবলধোলাই করা রীতিমতো এভারেস্ট জয় করার সমতুল্য। সেটাই করলো বাংলাদেশ।

রাওয়ালপিন্ডিতে প্রথম জয়টা এসেছিল ১০ উইকেটে। এবার ৬ উইকেটে। তাতে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের লড়াইয়ে পাকিস্তানকে ২-০ ব্যবধানে হারিয়ে আরো ১২ পয়েন্ট নিশ্চিত হলো। সঙ্গে গর্ব, সম্মান, ঐশ্বর্য্য যোগ হয়ে প্রাপ্তির ঝুলি একেবারে টইটুম্বুর। হাতে ১০ উইকেট রেখে ১৮৫ রানের লক্ষ্য ছুঁতে পঞ্চম দিনে ১৪৩ রানের প্রয়োজন ছিল বাংলাদেশের। কিন্তু সফরকারীদের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ ছিল প্রকৃতি।

আগের দিন শেষ সেশনে জাকিরের কাউন্টার অ্যাটাকে মাত্র ৭ ওভারে ৪২ রান তুলে নিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু প্রথমে আলোকস্বল্পতা, পরে বৃষ্টি; দুইয়ে মিলিয়ে ওপেনারদের ছন্দ নষ্ট করে। পঞ্চম দিনের সকালের সেশনে দুই ওপেনারের বিদায়ে পাকিস্তান কিছুটা আশার আলো দেখতে শুরু করে। কিন্তু শান্ত ও মুমিনুলের পঞ্চাশ পেরোনো জুটিতে স্বাগতিকদের সব আশা শেষ হয়ে যায়। দুই ব্যাটসম্যান অবশ্য জয় নিয়ে ফিরতে পারেননি। উইকেট উপহার দিয়েছেন প্রতিপক্ষকে।

৩২ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটিতে পাকিস্তানকে প্রথমবার টেস্টে হোয়াইটওয়াশ করে মাঠ ছাড়েন মুশফিক (২২) ও সাকিব (২১)। সকাল পেরিয়ে দুপুর। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। প্রকৃতি বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি, পাকিস্তানের বোলাররাও পেরে ওঠেনি। বড় ক্ষুধায় মগ্ন বাংলাদেশকে আটকাতে পারেনি কেউ। জয়ের যত কাছাকাছি গেছে বাংলাদেশ, হাসিমাখা ড্রেসিংরুমের আনন্দ-উচ্ছ্বাস দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ হয়েছে। স্মৃতি ধরে রাখতে শরিফুলকে দেখা গেল ম্যাচ জার্সিতে অটোগ্রাফ সংগ্রহ করতে। সাকিবের বাউন্ডারিতে জয় নিশ্চিতের পর মুশফিকের গগনবিদারী চিৎকার ধরা পড়ে টিভির সাউন্ডবক্সেও। সিজদাহতে সৃষ্টিকর্তার কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মাঠ ছাড়েন তিনি। স্টেডিয়ামের ডিজে বাজাতে থাকে, ‘জ্বলে ওঠো বাংলাদেশ, গর্জে ওঠো বাংলাদেশ। লাল সবুজের বিজয়ের নিশান, হাতে হাতে ছড়িয়ে দাও।’

এশিয়ার দলগুলোর মধ্যে খেলায় খেলোয়াড়দের শরীরী ভাষায় ভিন্ন এক তেজ কাজ করে। আবহও ভিন্ন তৈরি হয়। এক সময় তা কেবল পাকিস্তানের বিপক্ষে ছিল ইতিহাসের কারণে। সেটা এখন ভারত হয়ে শ্রীলঙ্কা ছাড়িয়ে আফগানিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত। ফলে খেলাটা যার সাথেই হোক না কেন, দেখিয়ে দেওয়ার একটা বিষয় থাকে। রাওয়ালপিন্ডিতে তেমন কিছু্ হলো। পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ জয়ের আড়ালে চাপা উল্লাস ঠিকরে বেরোচ্ছে দেখিয়ে দেওয়ার আনন্দ। শুধু পাকিস্তানকেই নয়, গোটা বিশ্বকে।

একই মাঠে প্রথম টেস্টে ১০ উইকেটের জয়ে বাংলাদেশ পেয়েছিল প্রবল আত্মবিশ্বাস। যে বিশ্বাস রেণু ছড়িয়েছিল সিরিজ জয়ের। এই সিরিজের আগে পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৩ টেস্টে কোনো জয় ছিল না। ১২ টেস্টেই ছিল হার। অথচ এবারের সফরে সব হিসেব পাল্টে দিয়ে বদলা নেওয়া শুরু করলো লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা।

টেস্টে বাংলাদেশের সাফল্য এসেছে কালেভাদ্রে। লম্বা সময় পরপর। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজসহ প্রায় সব বড় দলকেই হারিয়েছে বাংলাদেশ। তবে পারফরম্যান্সে ধারাবাহিকতার ছিল বড্ড অভাব। টেস্ট মেজাজ গড়ে না উঠা, পরিকল্পনার ঘাটতি, নিবেদন নিয়ে ছিল প্রশ্ন। সর্বোপরি টেস্ট আভিজাত্যের সঙ্গে খেয়ালি এক সম্পর্ক ছিল।

সব পেছনে ফেলে সাদা পোশাকের ক্রিকেটে নতুন এক সূর্যোদয় হলো। যে আলোয় আলোকিত হবে চারপাশ, এমন কিছুর স্বপ্নেই বিভোর গোটা বাংলাদেশ। অভিষেকের ২৪ বছর পর অন্তত পায়ের নিচের জমিন শক্ত হলো তা বলতে দ্বিধা থাকলো না। বাংলাদেশের পাকিস্তান দূর্গ জয় নিশ্চিতভাবেই টেস্ট ক্রিকেটে নতুন সঞ্জীবনী সুধা এনে দিবে।