টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে নেত্রকোণা সদর, দুর্গাপুর, কলমাকান্দা,পূর্বধলা ও বারহাট্টা উপজেলার প্রায় এক লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। এসব অঞ্চলে খাবারের পাশাপাশি গো-খাদ্য, বিশুদ্ধ পানির সংকট রয়েছে। গ্রামীণ সড়ক ডুবে যাওয়ায় চলাচলে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষদের।
দুর্গাপুরে ঢলের পানিতে ডুবে গতকাল সোমবার একজন মারা গেছেন বলে মঙ্গলবার (৮ অক্টোবর) জানিয়েছেন গাঁওকান্দিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য রুহুল আমীন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. নুরুজ্জামান জানান, জেলায় ১৭ হাজার ৫৩৫ হেক্টর জমির আমন ও ১৬৭ হেক্টর জমির শাক-সবজি তলিয়ে গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সারোয়ার জাহান জানান, মঙ্গলবার (৮ অক্টোবর) দুপুর ১২টার দিকে সোমেশ্বরী নদীর পানি কিছুটা বেড়েছে। এই নদীর পানি দুর্গাপুর পয়েন্টে বিপৎসীমার ২ দশমিক ১৪ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উপদাখালী নদীর পানি ধীর গতিতে কমতে শুরু করেছে। কলমাকান্দা পয়েন্টে নদীটির পানি বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ২৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে বইছে। কংশ নদের পানি জারিয়া পয়েন্টে কমে বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ৩৯ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে হাওরের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া ধনু নদের পানি খালিয়াজুরী পয়েন্টে বাড়ছে। সেখানে বিপৎসীমার ১ দশমিক ৬৯ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে বইছে এই নদের পানি।
সদর উপজেলার বন্যা কবলিত এলাকা কালিয়ারা-গাবরাগাতী ইউনিয়নের পাটলি গ্রামের মধ্য বয়সী নারী আমেনা আক্তার বলেন, ‘কেমনে বাঁচবাম, কিছুই বুঝতাছি না। কোমর হমান পানির মধ্যে কেমনে কি করাম। ঘরের মধ্যে পানি তই তই করতাছে। পোলাপান লইয়া বিপদে পড়ছি বেশি। হেরারে কি খাওয়াম। ঘরের মধ্যে থাহনেরই বাও নাই, রান্না কেমনে করাম। টয়লেটে যাওনের বাউ নাই। কইনছেন দেহি এইবায় কি আর বাঁচন যায়।’
আমেনা আক্তারের মতো গ্রামটির আরো কিছু পরিবারের একই অবস্থা। পাশের বাড়ি আরজ আলীও একই রকম কথা বলছিলেন।
জানা যায়, গত রোববার রাত থেকে বন্যার পানি ঢুকতে শুরু করে। সোমবার সকালে ইউনিয়নটির অন্তত ২০ টি গ্রামে পানি ঢুকেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েন গ্রামের পর গ্রামের বাসিন্দারা। দুর্গম এলাকার বানভাসি মানুষেরা ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ করছেন।
অভিযোগ স্বীকার করে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তানিয়া তাবাসসুম বলেন, ‘একই সঙ্গে চারটি ইউনিয়নসহ আরো কিছু নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। আমরা প্রত্যেকটা বাড়ি বাড়ি যাওয়ার চেষ্টা করছি। গত দুই তিন দিন ধরে আমাদের ত্রাণ কার্যক্রম চলছে। কিছু হয়তো অভিযোগ থাকতে পারে। আমরা সেই অভিযোগ প্রত্যেকটি আমলে নিচ্ছি। আমরা চেষ্টা করছি। আমাদের স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সহায়তায় আমরা দুর্যোগটি মোকাবিলা করার চেষ্টা করছি।’
এদিকে, দুর্গাপুরে প্লাবিত ৫টি ইউনিয়নের ৪০ টি গ্রাম থেকে ধীর গতিতে পানি নামতে শুরু করেছে। গতকাল সোমবার দুপুরে উপজেলার গাঁওকান্দিয়া ইউনিয়নের শ্রীপুর গ্রামে ঢলের পানিতে ডুবে রুসমত খান (৬০) নামে এক ব্যক্তি মারা গেছেন। আজ মঙ্গলবার সকালে বাড়ির চারপাশ পানি থাকায় তাকে সড়কের পাশে দাফন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন গাঁওকান্দিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য রুহুল আমীন।
রুহুল আমীন জানান, পানিতে পুকুর ডুবে বাড়ির আশপাশে বুক সমান পানি হয়েছে। পানিতে তলিয়ে থাকায় রুসমত খান যাওয়ার সময় বুঝতে পারেননি পুকুরটির অবস্থান। তিনি পুকুরে পড়ে পানিতে তলিয়ে মারা গেছেন।
দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, পানি ওঠায় বন্ধ রয়েছে ৭২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। উপজেলার ১০ হাজার হেক্টর ফসলি জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। শতাধিক মৎস্য চাষির পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। বন্যাদুর্গত এলাকায় বরাদ্দের ২০ টন চাল ও শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। এছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনরা পানিবন্দি মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করছেন।
কলমাকান্দা উপজেলার পাগলা এলাকার এনামুল হক বলেন, ‘তিন একর আমন লাগাইছিলাম। সবডাই তলায়া গেছে। কিছুই নাই।’
সদরের পাটলি গ্রামের মাছ চাষি রুকন উদ্দিন বলেন, ‘গতকাল আমার চাষ করা পুকুর বন্যার পানিতে তলায়। সব মাছ ভাইস্যা গেছে ‘
নেত্রকোণার জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস বলেন, ‘নতুন করে বারহাট্টা উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় এই মূহূর্তে জেলার ৫টি উপজেলা বন্যা কবলিত। ১০টি আশ্রয় কেন্দ্রে বানভাসী মানুষেরা আশ্রয় নিয়েছেন। জেলায় ৮৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থার মধ্যে রয়েছেন। এখন পর্যন্ত ৭০ মেট্রিক টন জিআর চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ২ হাজার শুকনো খাবারের প্যাকেট ও নগদ সাড়ে ৩ লাখ টাকা উপজেলাগুলোতে দেওয়া হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপজেলা পর্যায়ে আলাদা ত্রাণ রয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা শিশু খাদ্য বিতরণ করছেন। ত্রাণের কোনো ঘাটতি নেই। বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার কাজ চলছে।’