চেমসফোর্ডের আকাশে ঘন কালো মেঘ। আগেই একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। এবার তারাদের জেগে ওঠার পালা। অথচ দেখা নেই। তবে একজন ঠিকই তারকা হয়ে আলোকিত করে তুললেন চেমসফোর্ডের আঁধার রাত। যেমনটা বলছিলেন সাবেক ইংলিশ অধিনায়ক ও ধারাভাষ্যকর নাসের হুসেইন, ‘শান্ত ইজ গোয়িং টু বি এ স্টার ইন দ্য মেকিং...’
হ্যাঁ, নাজমুল হোসেন শান্তকে নিয়ে কথাটা আরও আগেই বলেছিলেন নাসের হুসেইন। ঘরের মাঠে ইংলিশদের বিপক্ষে শান্তর ব্যাটে রানের ফোয়ারা দেখে মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। শান্তর প্রথম ওয়ানডে শতকে ম্যাচ জয়ের দিনেও তার এই বাক্যটাই ফিরে আসছে বারবার।
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যানদের তালিকা করলে উপরের দিকেই থাকবেন এই ডানহাতি ব্যাটসম্যান। তবে উপরের দিকে ওঠার আগে নিচের পথটুকু শান্তর জন্য ছিল ভীষণ পিচ্ছিল, কর্দমাক্ত। সেই পথ মাড়াতে গিয়ে বারবার হোঁচট খেয়েছেন, আঘাত পেয়েছেন, গিরিখাদের মৃত্যুকূপ দেখেছেন। কিন্তু হারিয়ে যাননি, হারাতে চাননি।
শান্তকে খুব কাছ থেকে দেখা দেশের অনেক ক্রিকেটারের গুরু নাজমুল আবেদীন ফাহিম যেমনটা বলেন, ‘শান্ত’র সবচেয়ে বড় গুণ সে মানসিকভাবে শক্তিশালী। এতো কিছুর পরেও মানসিকভাবে কখনো ভেঙ্গে পড়েনি। এটা একটা ইঙ্গিত যে শান্ত ধীরে ধীরে বাংলাদেশের ক্রিকেটের গুরুত্বপূর্ণ একজন চরিত্র হয়ে উঠবেন।’
বাংলাদেশের ক্রিকেটে শান্ত যে গুরুত্বপূর্ণ একটা চরিত্র হয়ে উঠবেন সেটা ২০১৬ সালেই টের পাওয়া গিয়েছিল। যুব বিশ্বকাপের সেই আসরেই নক্ষত্র হয়ে ওঠার একটা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন এই বাঁহাতি। সেই আসরের একটা ছবি এখনো অনেকের চোখে ভাসে।
চেমসফোর্ডে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে সেঞ্চুরির পর ক্ষ্যাপাটে উদযাপনের আগ পর্যন্ত ওটাই ছিল শান্তর সবচেয়ে আইকনিক ছবি। কক্সবাজারের শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সেঞ্চুরি করে ব্যাট হেলমেট ছুঁড়ে শূন্যে লাফিয়ে উঠেছেন শান্ত। যেন শিখর ছুঁতে চাচ্ছেন।
শিখর ছোঁয়ার লক্ষ্য নিয়েই বাইশ গজে পা রেখেছিলেন শান্ত। যুব বিশ্বকাপ দিয়ে পথচলার শুরু। শুরুতেই দেখিয়েছেন উল্কার ঝলক। আক্ষরিক অর্থেই ওই সময় যুব ক্রিকেটের মহাতারকা ছিলেন তিনি। কেমন ছিলেন সেটা বোঝাতে ছোট্ট একটা তথ্য দিই, অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেটের ইতিহাসেরই সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান।
যুব ক্রিকেটের ইতিহাসে ৫৮ ম্যাচের ৫৭ ইনিংসে ৩৭.৯১ গড়ে ১,৮২০ রান নিয়ে এখনো শীর্ষে অবস্থান করেছেন শান্ত। তখন থেকেই তাকে ধরা হতো বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভবিষ্যতের ‘নেক্সট বিগ থিং’। ঘরোয়া ক্রিকেটেও স্টার মার্ক তুলে আগমনী বার্তা জানান দিয়েছিলেন এই ওপেনার।
২০১৭ সালে সাদা পোশাকের ঔজ্জ্বল্য গায়ে লেপ্টে দেশের হয়ে শান্তর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যাত্রার শুরু। মূলত এখান থেকেই শুরু শান্তের হোঁচট খাওয়ার অধ্যায়। ঘরোয়াতে রানের ফুলঝুরি ছোটানো তরুণ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এসে ঠিক মানিয়ে নিতে পারলেন না। অচেনা মনে হলো সব!
প্রভাবটা পড়লো ব্যাটে, বেশ জোরেশোরেই। একই সঙ্গে শুরু হলো স্বভাবজাত বাঙালির খোঁচার বহর। এ যেন ‘ছুটি’ গল্পের সেই ফটিক। তবে ফটিকের মতো শান্ত ছুটি নিলেন না। যে কথাটা বলেছিলেন ফাহিম, ‘শান্ত মানসিকভাবে বেশ শক্তিশালী...।’ মানসিক শক্তিটুকু সম্বল করেই টিকে থাকার লড়াইয়ে নামলেন এই প্রতিভাবান।
শান্তর প্রতি সমর্থকদের একটা বড় অংশের ক্ষোভ একটু বেশিই ছিল। খোঁচার তীর হজম করতে করতে একটা সময় ছিন্নভিন্ন ডগার মতো লুটিয়ে পড়লেন শান্ত। বেদনা মেশানো কণ্ঠে উগড়ে দিলেন পুষে রাখা বিষাদের সবটুকু, ‘কখনো কখনো মনে হয়, গোটা দেশের বিরুদ্ধে খেলি আমি।’
এতোকিছুর পরও শান্ত আস্থা আর ভরসাটুকু পেয়েছিলেন। বারবার ব্যর্থ হওয়া সত্ত্বেও প্রতিভার কদরটুকু জুটেছিল ভাগ্যে। অফস্ট্যাম্পের বলে খোঁচা মেরে স্লিপে ধরা খাওয়া, লেট সুইংয়ের ধোঁকায় পরাস্ত হওয়া কিংবা মিস টাইমিংয়ে তাল হারিয়ে ফেলা; নিজেকেই যেন অচেনা মনে হচ্ছিলো তার।
সব সামলে চেনা জগৎটা শান্ত ফিরে পেলেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মঞ্চে। বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি রান ছিল তার, বিশ্বকাপের সেরা পাঁচ রান সংগ্রাহকদের একজন হিসেবে বিরাট কোহলিদের পাশে নাম লিখিয়েছিলেন এই ওপেনার। ৫ ম্যাচে ৩৬ গড়ে ১১৪.৬৪ স্ট্রাইকরেটে ১৮০ রান করেন শান্ত। ফিফটি হাঁকিয়েছেন তিনটি।
বিশ্বকাপের আত্মবিশ্বাসটা সঙ্গী করে বিপিএলে ব্যাটে ছড়িয়েছেন রঙিন আলোর রোশনাই। হয়েছেন আসর সেরা ও সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঘরের মাঠেও চিরচেনা রূপে আবির্ভূত হন এই ব্যাটসম্যান। তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে ১ ফিফটিতে ৪৮ গড়ে করেন ১৪৪ রান। সিরিজ সেরার সুবাতাস নিয়েই পা রাখেন ইংল্যান্ডে।
চেমসফোর্ডেও আইরিশদের বিপক্ষে ওয়ানডেতে সেঞ্চুরি করেই বুনো আর ক্ষ্যাপাটে উদযাপনে মাতলেন শান্ত। দু’বার লাফ দিলেন, হাসলেন, শেষে ব্যাট উচিয়ে সবার উদ্দেশ্য দিলেন উড়ন্ত চুমো। এমন উদযাপন করার জন্য এর চেয়ে ভালো উপলক্ষ্য আর কোথায় পেতেন তিনি? এর আগে যে ওয়ানডেতে ২১ ইনিংস খেলেও তার কোনো সেঞ্চুরি ছিল না!
৯৩ বলে ১১৭! ১২৫.৮১ স্ট্রাইক রেটে তিন অংকের ম্যাজিক ফিগার নিয়ে ড্রেসিংরুমে ফিরছেন শান্ত। চেমসফোর্ডের আকাশটা ইঙ্গিত দিচ্ছে প্রবল বর্ষণের। তবে বৃষ্টি নামেনি। ফ্লাডলাইটের আলোয় সোনালি বিন্দুকণাও আর ঝরে পড়েনি। সেটার প্রয়োজনও বোধহয় ছিল না। শান্ত নিজেই তো নিকশ আঁধারে ছড়িয়ে দিয়েছেন জোনাকির আলো।