বিশ্বকাপ সব সময়ই বিশেষ কিছু। বিশ্বকাপ একটি সুযোগ, নিজেদের সামর্থ্য ও যোগ্যতার প্রমাণ দেওয়ার। নিজেদের শক্তিমত্তার সেরাটা জানান দেওয়ার। তাইতো বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাওয়া একটি দেশ ও তাদের প্রতিটি খেলোয়াড়ের জন্য আরাধ্য বিষয়।
বিশ্বকাপের মঞ্চে একটি দল কেবল অংশ নেওয়ার জন্য যায় না। তারা তাদের সেরাটা নিংড়ে দিয়ে ভালো কিছু উপহার দেওয়ার আশা নিয়ে যায়। কারও কারও লক্ষ্য থাকে আরও উঁচুতে, চোখ থাকে আরও বড় কিছুতে। তাইতো বিশ্বকাপে অনেক সময় অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী দলগুলোও হারিয়ে দেয় শক্তিধর দলকে। জন্ম দেয় অঘটনের।
ক্রিকেট বিশ্বকাপে এমন ঘটনা কম ঘটলেও ঘটে না যে এমন নয়। এবারের ক্রিকেট বিশ্বকাপও হয়তো তার ব্যতিক্রম হবে না। তবে বিচার বিশ্লেষণ করে দেখা যাক এবার কোন দলটি হবে অঘটন-ঘটন পটিয়সী।
বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া টেস্ট খেলুড়ে দলগুলোর র্যাংকিং বিচারে নিচের দিকে আছে আফগানিস্তান। তারা আছে ওয়ানডে র্যাংকিংয়ে নবম স্থানে। কিন্তু টেস্ট খেলুড়ে দেশ নয়, র্যাংকিংয়েও শীর্ষ দশের কাছাকাছি অবস্থানে নেই, এমন একটি দলের নাম নেদারল্যান্ডস। ১৯ দলের ওয়ানডে র্যাংকিংয়ে তারা অবস্থান করছে ১৪তম স্থানে।
কিন্তু র্যাংকিংয়ে কি আসে যায়? দিনশেষে পারফরম্যান্সই তাদের হয়ে কথা বলে। গেল জুন-জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, জিম্বাবুয়ে, স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের মতো দলগুলোকে পেছনে ফেলে তারা ফাইনাল খেলেছিল এবং নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে পঞ্চমবারের মতো বিশ্বকাপের মঞ্চে জায়গা করে নিয়েছে।
বাছাইপর্বের গ্রুপপর্বে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই তারা স্বাগতিক জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৬ উইকেটে ৩১৫ রানের বিশাল সংগ্রহ দাঁড় করায়। যদিও সিকান্দার রাজার অতিমানবীয় ইনিংসে তাদের হারতে হয়। পরের ম্যাচে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে ৫ উইকেটের দারুণ জয় পায়। তৃতীয় ম্যাচে নেপালকে ১৬৭ রানে অলআউট করে জয় পায় ৭ উইকেটে।
২০১১ সালের পর আবার বিশ্বকাপে জায়গা করে নিতে নেদারল্যান্ডসের সামনে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আগে ব্যাট করে দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন উইন্ডিজ ৬ উইকেটে ৩৭৪ রানের বিশাল সংগ্রহ দাঁড় করায়। এই রান তাড়া করে শেষ ম্যাচটি ডাচরা জিতবে সেটা হয়তো কেউ কল্পনাও করেনি। কিন্তু তেজা নিদামানুরুর সেঞ্চুরিতে ভর করে শেষ ১২ বলে ৩০ রান তুলে রুদ্ধশ্বাস ম্যাচটি টাই করে তারা। এরপর সুপার ওভারে লোগান ফন বিক ৩টি ছক্কা ও ৩টি চারে ৩০ রান তুলে উইন্ডিজকে ছিকটে দেন বিশ্বকাপ থেকে। সুপার ওভারে ২২ রানের জয়ে সুপার সিক্সে নাম লিখিয়ে বিশ্বকাপে এক পা দিয়ে রাখে নেদারল্যান্ডস।
এরপর সুপার সিক্সে ওমান ও স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে দুর্দান্ত জয় তুলে নিয়ে বাছাইপর্বের ফাইনাল নিশ্চিত করার পাশাপাশি ১২ বছর পর ওয়ানডে বিশ্বকাপ নিশ্চিত করে।
নেদারল্যান্ডসের অনেক খেলোয়াড়রই ইংল্যান্ডের কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপে খেলেন। সে কারণে বিশ্বকাপ বাছাইর্বে তারা ফ্রেড ক্লাসেন, পল ফন মিকারেন, কলিন অ্যাকারম্যান, রোলফ ফন ডার মারউয়ি ও ব্রেন্ডার গ্রেভারকে পায়নি তারা। এছাড়া কাউন্টিতে খেলায় পায়নি পেসার শেন স্ন্যাটার ও টিম ফন ডের গুগটেনকে।
তবে বিশ্বকাপের স্কোয়াডে কাউন্টিতে ভালো করা এবং আগে বিশ্বকাপ খেলার অভিজ্ঞতা আছে এমন খেলোয়াড়দের জায়গা করে দিয়েছে রয়্যাল ডাচ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন। ১৫ সদস্যের দলে তারা রেখেছে কলিন অ্যাকারম্যান, পল ফন মিকারেন ও রোলফ ফন ডার মারউয়িকে। এছাড়া দলে জায়গা করে দিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে খেলা সিব্র্যান্ড অ্যাঙ্গেলব্রেখটকেও। এছাড়া জিম্বাবুয়েতে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে দারুণ পারফর্ম করা অন্যান্য খেলোয়াড়রা অনুমেয়ভাবে আছেন বিশ্বকাপ দলে।
নেদারল্যান্ডস এর আগে ১৯৯৬, ২০০৩, ২০০৭ ও সবশেষ ২০১১ বিশ্বকাপে খেলেছিল। প্রথম আসরে ৫ ম্যাচ খেলে পাঁচটিতেই হেরেছিল। তবে ২০০৩ বিশ্বকাপে এসে নিজেদের প্রথম জয় তুলে নেয় তারা। অস্ট্রেলিয়া, ভারত, জিম্বাবুয়ে, ইংল্যান্ড ও পাকিস্তানের মতো শক্তিশালী দলের বিপক্ষে সুবিধা করতে না পারলেও নামিবিয়ার বিপক্ষে তারা দারুণভাবে জ্বলে ওঠে। ৪ উইকেটে ৩১৪ রান করে জয় পায় ৬৮ রানে।
২০০৭ বিশ্বকাপেও তারা যথারীতি একটি জয় পায়। অস্ট্রেলিয়া দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে আত্মসমর্পণ করলেও স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ৮ উইকেটের বড় ব্যবধানে জয় পায়। ২০১১ বিশ্বকাপটি তাদের জন্য ছিল হতাশার। ৬ ম্যাচ খেলে একটিতেও জয় পায়নি। যদিও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২৯২ রান করেও হার মানে। এবং আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ৩০৬ রান করেও হেরে যায়।
এরপর ২০১৫ ও ২০১৯ বিশ্বকাপে খেলা হয়নি তাদের। এবার তারা আরও শক্তিশালী, আরও অভিজ্ঞতার ঝুলি নিয়ে জায়গা করে নিয়েছে ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপে। এবার তারা নিজেদের প্রমাণ করতে প্রস্তুত।
নেদারল্যান্ডসের শক্তিমত্তার দিক তাদের ভয়-ডরহীন ব্যাটিং। বাস ডি লিড, ম্যাক্স ও’ডড, বিক্রমজিৎ সিং ও স্কট অ্যাডওয়ার্ডসের মতো ব্যাটসম্যান; কলিন অ্যাকারম্যান, লোগান ফন বিক, তেজা নিদামানুরু, রোলফ ফন ডার মারউয়ির ও সাকিব জুলফিকারদের মতো অলরাউন্ডাররা নিজেদের দিনে যেকোনো দলের বোলারদের তুলোধুনো করতে পারেন। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে তারা যেমনটা করেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলারদের।
এবার যেহেতু লিগ পদ্ধতিতে বিশ্বকাপ হবে, সব দল সবার বিপক্ষে খেলবে, সেহেতু নেদারল্যান্ডসের অঘটন ঘটানোর সম্ভাবনা বেশি। যদিও ওয়ানডে বিশ্বকাপের আগের চার আসরে তারা কখনো বড় কোনো দলকে হারাতে পারেনি। কিন্তু এবার তাদের সামনে দারুণ সুযোগ আছে সেটার।
তার ওপর তাদের ব্যাটসম্যান, বোলার ও অলরাউন্ডাররা আছেন দারুণ ফর্মে। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে তাদের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স এখনও তরতাজা। সেই সাথে ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানোর অভিজ্ঞতা। তাই বলা যায়, ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডসের অঘটন ঘটানোর সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।