হাত মেলে এমনভাবে দৌড়াচ্ছিলেন যেন ডানা মেলে আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছেন! স্রেফ একটি ক্যাচ নেওয়ার আনন্দ তাকে ছুঁয়ে গিয়েছে এমনটা ভাবলে হয়তো ভুল হবে। তার থাকার কথা ছিল রাজশাহীতে, জাতীয় লিগের পরবর্তী ম্যাচ খেলতে। অথচ তিনি এখন বিশ্বকাপ মঞ্চে। সাকিবের পরিবর্তে বিশ্বকাপে সুযোগ পাওয়া এনামুল অপেক্ষায় অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলার। একাদশে সুযোগ মিলবে কিনা জানেন না হয়তো। কিন্তু বিশ্বকাপ দলে থাকাটাই যেন তার পরম পাওয়া।
গ্রাউন্ড ফিল্ডিংয়ে সীমানায় হাই ক্যাচ অনুশীলন চলছিল। অনেকটা উচুঁতে আসা ক্যাচ তালুবন্দি করেছিলেন ঠিকঠাক। কিন্তু ভারসাম্য রাখতে পারলেন না। তাই বাউন্ডারির আগে বল শূন্যে ছুঁড়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেন। পরে ঝাঁপিয়ে পড়েন পুনের সবুজ গালিচায়। পাশ থেকে তাওহীদ হৃদয় আঙুল উঁচিয়ে বললেন আউট। সাধ্যের বাইরে গিয়ে অনুশীলনে এমন নিবেদন দেখানোয় তালিও পেয়েছেন। সেজন্য এনামুল মেলেছিলেন ডানা।
সাকিব আল হাসানের আঙুলের চোটে এনামুলকে দেশ থেকে উড়িয়ে এনেছে টিম ম্যানেজমেন্ট। বাড়তি ব্যাটসম্যান বিশ্বকাপ স্কোয়াডে নেই। সাকিবের পরিবর্তে তাই ব্যাটসম্যানকেই প্রয়োজন হলো দলের। কিন্তু অনুশীলন দেখে বোঝার উপায় হলো না, তার একাদশে থাকার সম্ভাবনা কতটুকু।
যেখানে সাকিব ও মিরাজসহ বিশেষজ্ঞ বোলার ছিলেন ৫ জন। সাকিবের জায়গায় তাই একজন বোলারকেই নিতে হবে নিশ্চিতভাবে। সেক্ষেত্রে এনামুলকে একাদশে সুযোগ দিলে বাদ পড়তে হবে তানজিদকে। কিন্তু মহারাষ্ট্র ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন স্টেডিয়ামে বৃহস্পতিবারের অনুশীলনে তানজিদই গেলেন সবার আগে নেটে। সঙ্গে মুশফিকুর রহিম ও নাজমুল হোসেন শান্ত। তিনজন ঘুরে ফিরে স্পিনার, পেসার ও থ্রোয়ারদের খেলেছেন।
এনামুলের শুরুর অনুশীলন ছিল সাদামাটা। শুরুতে ‘টিম বয়ের’ ভূমিকা। একে ওকে এটা ওটা এগিয়ে দেন। কখনো আম্পায়ারের ভূমিকায়। কখনো ছাতার নিচে বসে থাকেন। কখনো নেটের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। কখনো কোচের সঙ্গে কথায় মগ্ন। পরে এনামুল দারুণ টিম ম্যান। ফিল্ডিং এবং ক্যাচ অনুশীলনে একেবারেই প্রাণবন্ত, নিবেদিতপ্রাণ। যখন যেখানে তাকে ফিল্ডিংয়ে পাঠিয়েছে সেখানেই দৌড় ঝাঁপ দিয়ে শতভাগ উজার করে দিয়েছেন। শেষে এনামুল যেন টিম লিডার। লম্বা সেশন ব্যাটিং করার পর দুই হাত পেছনে নিয়ে যেভাবে ২২ গজ পরীক্ষা করেছেন দূরে থেকে মনে হয়েছে নিয়মিত অধিনায়ক সাকিবের অবয়ব।
নেটে শুরুতে স্পিনারদের খেলেন ডানহাতি ব্যাটসম্যান। জাতীয় লিগে লাল বলে খেলে এসেছেন। এখানে শুরুতে তাই সাদা বলে খেলে আই কনটাক্ট ঠিক করেছেন। ধারাবাহিক রানে থাকায় শুরু থেকে সাবলীল ব্যাটিং করেছেন। মিনিট দশেক স্পিনারদের খেলার পর পেসারদের নেটে চলে যান। সেখানে মোস্তাফিজ, হাসান, তাসকিন ও তানজিমের বল খেলেন। হাসানের এক বাউন্সার পুল করতে গেলে মিস করেন। বল আঘাত করে তার হেলমেটে। পাশে থাকা ডাক্তার মঞ্জু দৌড়ে ভেতরে যেতে চাইলেও এনামুল ফিরিয়ে দেন। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর খেলেন পরের বল। তার লম্বা ব্যাটিং সেশনের শেষটা হয় থ্রো ডাউন খেলে। যেখানে বল উড়িয়েছেন মাঠের এদিক-ওদিক।
পুনেতে বাংলাদেশের মিশন এক, এনামুলের আরেক। বাংলাদেশ বিশ্বকাপের ব্যর্থ মিশন জয় দিয়ে শেষ করতে চাইবে। কেবল এক ম্যাচের জন্য দলের সঙ্গে যোগ দেওয়া এনামুল সেই জয়ে অবদান রাখতে চাইবেন। সুযোগ পেলে রানের ফুলঝুরি ছোটাতে চাইবেন। তার বিশ্বকাপ রোমাঞ্চে দল হাসতে পারলে হাসিটা চওড়া হবে তারও।
ইনজুরিতে পড়েই ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ দল থেকে ছিটকে গিয়েছিলেন এনামুল। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ফিল্ডিংয়ের সময় কাঁধে চোট পান। সৌম্য সরকার তার জায়গা নিয়ে নিজেকে থিতু করেন। এনামুল পরে সুযোগ পেলেও মেলে ধরতে পারেননি। এরপর নানা সময় তার আসা-যাওয়া, কিন্তু পায়ের নিচের জমিন শক্ত হয় না। ২০১৯ বিশ্বকাপে সুযোগ পাননি, দলে ছিলেন না এবারও।
কিন্তু ভাগ্য তাকে আবার ফিরিয়েছে বিশ্বকাপ মঞ্চে। সেই ইনজুরি নামক দুর্ভাগ্য তার জীবনে সৌভাগ্য হয়ে এলো। সুযোগ পেলে সাদামাটা ক্যারিয়ারের পাতায় নতুন অধ্যায় যুক্ত করতে পারেন কিনা সেটাই দেখার। ক্লাসের লাস্ট বয়ও কখনো কখনো তীব্র চেষ্টায় সব সমীকরণ পাল্টে দিতে পারেন। বিশ্বকাপ দলের ‘লাস্ট বয়’ এনামুলের সেই সুযোগটি খুলে যেতে পারে সেরা একাদশে সুযোগ পেয়ে। আগে বহুবার এমন সুযোগ পেয়েছেন। গোনায় ধরার মতো পারফর্ম করতে পারেননি। এবার প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া। মঞ্চ বিশ্বকাপ। যেখানে গোটা বিশ্বের চোখ থাকে। এবার না হলে আবার কবে পারফর্ম করবেন? নিজে ডানা মেলেছেন। ২২ গজে তার ব্যাটের ডানা মেলার অপেক্ষা।