খেলাধুলা

হারের সঙ্গী নানা প্রশ্ন

ধরে নিন মিরপুরে ফকফকা আকাশ। রৌদ্রজ্জ্বল আবহাওয়া। বৃষ্টির বাধা নেই। নেই আলোকস্বল্পতা কিংবা সকালের ঘন কুয়াশা। লাল বল, সাদা পোশাকের ক্রিকেট টেস্টের জন্য এক আদর্শ পরিবেশ। এমন পরিবেশে যদি সদ্য শেষ হওয়া ঢাকা টেস্টটি হতো তাহলে কয়দিনে খেলা গড়াত?

দুদিন, তিনদিন নাকি চারদিন! স্কোরবোর্ড বলছে, ঢাকা টেস্টে খেলা হয়েছে ১৭৮.১ ওভার। মানে নির্ঝঞ্জাট খেলা হলে ঢাকা টেস্ট শেষ দুদিনেই! যেখানে শেষ হাসি হেসেছে নিউ জিল্যান্ড। অথচ বাংলাদেশের সুযোগ ছিল টেস্ট স্বীকৃতি পাওয়ার পর প্রথম এক বছরে কোনো টেস্ট না হারার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার। ৪ উইকেটের হারে তা হয়নি।

মিরপুরে খেলা মানেই স্পিন বধ্যভূমি। হয়েছেও তাই। স্পিনে ফাঁদ পেতে বাংলাদেশ নিউ জিল্যান্ডকে সিলেটের পর ঢাকায়ও হারাতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষমেশ নিজেদের পাতা ফাঁদে আটকা পড়ে বাংলাদেশ। ১৭৮.১ ওভারের খেলায় উইকেট পড়ল ৩৬টি। স্পিনারদের পকেটে ৩১ উইকেট। বাকি ৫টি পেসারদের। যেখানে ব্যাটিং গড় ১৬.৬১, যা বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত যে কোনো ম্যাচে সর্বনিম্ন।

হার যেমন-তেমন কোনো হার নয়। স্রেফ বিব্রতকর। প্রথম ইনিংসে ১৭২ রানের পর দ্বিতীয় ইনিংসে অলআউট ১৪৪ রানে। স্পিনে ঘায়েল করতে নিউ জিল্যান্ডকে ধীর গতির, ঘূর্ণির অসমান বাউন্সের উইকেট অফার করেছিল। যে উইকেট লম্বা সময় ধরে বাংলাদেশের জন্যই দুর্বোধ্য সেখানে অতিথিদের জন্য আনপ্লেয়বল হওয়ার কথা। অথচ কিউইরা বড্ড পেশাদার। পিছিয়ে পড়ে কিভাবে ম্যাচ জিততে হয়, বিরুদ্ধ কন্ডিশনে কিভাবে লড়াই করতে হয়, স্বাগতিক সুবিধা ছাপিয়ে কিভাবে বিজয়ের কেতন উড়াতে হয় সব তাদের জানা। এজন্য নিউ জিল্যান্ডের অধিনায়ক জয়ের পরও বলতে দ্বিধা করেননি, ‘আমার ক্যারিয়ারে সম্ভবত সবচেয়ে খারাপ উইকেট।’

প্রথমদিনের মতো চতুর্থ দিনেও উইকেট পড়লো ১৫টি। বাংলাদেশ ৮ উইকেট হাতে দিন শুরু করে ১১৫ মিনিটেই শেষ দ্বিতীয় ইনিংস। অদ্ভুতুড়ে একেকটি শট, উইকেট ‘আত্মহত্যা’ দিয়ে আসা-যাওয়ার মিছিল স্বাগতিক শিবিরে। উইকেট দুরূহ তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু কঠিনতম উইকেটে ইস্পাত দৃঢ় মানসিকতার ঘাটতি ফুটে ওঠে প্রবলভাবে।

নিউ জিল্যান্ড শিবিরেও তাই। মাত্র ১৩৭ রানের তাড়ায় টপ অর্ডার টপলেস। মিডল অর্ডার বোনলেস। লক্ষ্যের অর্ধেক রান, ৬৯ তুলতে গিয়ে তাদের ৬ ব্যাটসম্যান ড্রেসিংরুমে। পরাজয় তখন উঁকি দিচ্ছিল তখন দেয়াল হয়ে দাঁড়ান প্রথম ইনিংসে ৮৭ রান করে নিউ জিল্যান্ডকে ৮ রানের লিড এনে দেওয়া গ্লেন ফিলিপস। তাকে সঙ্গ দেন মিচেল স্যান্টনার। দুজনের অবিচ্ছিন্ন ৭০ রানের জুটিতে কিউইরা টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের তৃতীয় চক্রের প্রথম ১২ পয়েন্ট নিশ্চিত করে। চার মেরে দলকে জয়ের বন্দরে নিয়ে যাওয়া ফিলিপস ৪০ করে ম্যাচসেরা। তবে স্পিন জোয়ারে ভেসে যাওয়া সিরিজে ১৫ উইকেট নিয়ে সেরা তাইজুল।

ম্যাচ হারলে ভুলগুলো সামনে আসে। জিতলে আড়াল হয়ে যায়। তা নতুন নয়। তবে এই টেস্টকে ঘিরে আলোচনায় নানা প্রশ্ন। যে দলের অধিনায়ক বিশ্বকাপ ভরাডুবির পর স্পোর্টিং উইকেটে খেলার কথা বলেছিলেন তিনিই কিভাবে মিরপুরে এমন স্পিন বধ্যভূমিতে খেলতে চাইলেন? প্রশ্ন আরও উঠেছে, এমন উইকেটে খেলে কতদূর এগোবে দেশের ক্রিকেটের মান? ব্যাটসম্যানদের বড় রান করতে না পারার যে অনভ্যস্ততা তা লম্বা সময়ে কতটা ভোগাবে?

এসবের পরিকল্পনার মূলে রয়েছেন কোচ চণ্ডিকা হাথুরুসিংহে। আগের দফায় বাংলাদেশের কোচ হয়ে স্বাগতিক সুবিধা নেওয়ার বীজ তিনি বপণ করেছিলেন। তাতে ২০১৬ সালে ইংল্যান্ড, ২০১৭ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচ জিতেছিল বাংলাদেশ। হিতে বিপরীতও হয়েছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারতের বিপক্ষে টেস্ট হেরেছে। এমনকি জিম্বাবুয়েও হারিয়েছে বাংলাদেশ। এবারও হলো।

সব মিলিয়ে স্বাগতিক সুবিধা নিয়ে দুয়েকটি জয়ে পাওয়া যে মেকি আত্মবিশ্বাস তা কাজে আসেনি। বরং বাংলাদেশ বরাবর স্পোর্টিং উইকেটে খেলে ভালো ফল পেয়েছে। নিউ জিল্যান্ডকে তাদের মাটিতে হারানো এবং শ্রীলঙ্কায় গৌরবের ড্র হয়েছিল স্পোর্টিং উইকেটে খেলেই। যেখানে ব্যাট-বলের লড়াইয়ের ভারসাম্য ছিল। সিলেটে কিছুদিন আগেই যে টেস্ট জিতেছিল সেটাও ছিল দারুণ। ব্যাট-বলের লড়াই জমেছে। শেষ পর্যন্ত স্বাগতিক বাংলাদেশ জয় পেয়েছে। ঢাকায় নেমেই উল্টো ফল।

বাংলাদেশ শিখবে কবে? শিখবে কোথায়? পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৬ সালে ইংল্যান্ড এবং ২০১৭ সালে অস্ট্রেলিয়াকে ঢাকায় হারানোর পর বাংলাদেশ দেশে ও বাইরে মিলিয়ে ৪০ টেস্ট খেলেছে। যেখানে জয় মাত্র ৯টি। হার ২৭টি। ড্র ৩টি।

টেস্ট ক্রিকেটে নিজেদের এগিয়ে যাওয়া, দলের সামগ্রিক ফলাফল নিয়ে যখন নানা প্রশ্ন চারিদিকে উঁকি দিচ্ছে তখন সাকিবের পরিবর্তে এই সিরিজে নেতৃত্ব দেওয়া শান্ত সাফ জানিয়ে দিলেন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট উন্নতির জায়গা নয়। জয়ের মঞ্চ। ঘরোয়া ক্রিকেটে সব শিখেই আসতে হবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। প্রতিপক্ষকে হারাতে এই ধরণের উইকেটেও সামনে খেলবে বাংলাদেশ এমন বার্তাও পাওয়া গেল তার কণ্ঠে, ‘আমরা এখানে উন্নতি করতে আসিনি। জিততে এসেছি। এখানে জেতার জন্য এই ধরণের সুবিধা নেওয়া উচিত।’

জয়ের নেশা ও মেকি আত্মবিশ্বাসে বাংলাদেশের ক্রিকেটের ‘ইউটার্ন’ আজকের ঘটনা নয়। লম্বা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও হচ্ছে না উপলব্ধি। ক্রিকেটারদেরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে তা নতুন নয়। তালগোল পাকানো পারফরম্যান্সও হচ্ছে নিয়মিত। ঢাকা টেস্ট হারের তিক্ত স্বাদ এখনো তরতাজা।

এ টেস্টকে ঘিরে বাংলাদেশর সম্ভাবনার সূর্য বহু আগেই অস্তমিত হয়েছিল। প্রথম ইনিংসে ১৭২ রান করে। হয়তো আরও আগে! এবরো-থেবড়ো উইকেট বানিয়ে। যা নিজেদের স্পোর্টিং উইকেটের যে দাবি বিশ্বকাপে ভরডুবির পর ছিল, তার সম্পূর্ণ বিপরীত।