রেকর্ড তো হয় ভাঙার জন্যই। ইতিহাসের পাতায় সব সময়ই যোগ হয় নতুন অধ্যায়। টেস্ট ক্রিকেটের বয়স ১৪৭ বছর পেরিয়েছে। রাওয়ালপিন্ডিতে বাংলাদেশ পাকিস্তান খেলছে ২ হাজার ৫৪৭ নম্বর টেস্ট। লম্বা এই সময়ে অযুত-নিযুত কীর্তি ইতিহাসের অক্ষয় কালিতে লিখা হয়েছে। তবে লিটন ও মিরাজ রাওয়ালপিন্ডির ২২ গজে যা করে দেখালেন তা হয়নি আগে কখনো, কোথাও।
২৬ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে পিন্ডি টেস্টের তৃতীয় দিনের সকালটা বাংলাদেশের জন্য দুঃস্বপ্নের। সফরকারী ব্যাটসম্যানরা তখন পায়ের নিচের জমিন খুঁজে পাচ্ছিলেন না। অথচ সাত সকালে পথ হারানো বাংলাদেশ ইনিংস শেষ করে ২৬২ রান তুলে! ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে প্রতি আক্রমণে গিয়ে আশার ফুল ফুটিয়ে অনন্য, অসাধারণ একটি দিন উপহার দিয়েছেন দুই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। দুঃস্বপ্নের পর স্বপ্নময় একটি দিন। যার শেষটা আরও রঙিন।
সপ্তম উইকেট জুটিতে মিরাজ-লিটন করলেন ১৬৫ রান। ৩০ কিংবা তার কম রানে ৬ উইকেট হারিয়ে সপ্তম উইকেট জুটিতে কোনো দল ১৫০ রানের বেশি কখনো করতে পারেনি। সেখানে মিরাজ ও লিটন উপহার দিয়েছেন ঝকঝকে জমাট দৃঢ়চেতা এক জুটি। বিশ্ব রেকর্ড হিসেবে যা লিখা হয়ে গেল ইতিহাসের পাতায়। পাকিস্তানি বোলারদের কল্পনাকেও হার মানিয়ে তীব্র সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ যে ইনিংস খেলেছেন দুজন, তা স্মৃতির পাতায় জমা থাকবে লম্বা সময়। বিশ্ব রেকর্ড আর রঙিন দিনের কেবল একটাই আক্ষেপ।
মিরাজের সেঞ্চুরি মিস! ৭৮ রানে যখন মিরাজ ড্রেসিংরুমের পথ ধরেন তখন লিটন ৮২ রানে দাঁড়িয়ে। দুইবার পায়ে ক্র্যাম্প হওয়ায় ঠিকঠাক রানিং করতে পারছিলেন না। ব্যাটিংয়ে ছিল জড়তা। কিন্তু ২২ গজে লম্বা সময় কাটিয়ে লিটন তুলে নেন ক্যারিয়ারের চতুর্থ টেস্ট সেঞ্চুরি। শেষ বিকেলে শেষ ঘণ্টায় যখন সাজঘরে ফেরেন তখন নামের পাশে জ্বলজ্বল করছিল ১৩৮ রান। ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্কোর।
নবম ব্যাটসম্যান হিসেবে লিটন আউট হওয়ার সময় বাংলাদেশ ১২ রানে পিছিয়ে ছিল। হাসান ও রানা জুটি সেই রান কমাতে পারেনি। পাকিস্তান ১২ রানের লিড পেলেও প্রথম ইনিংসের লড়াইটা কার্যত বাংলাদেশই ‘এগিয়ে’ বললে দ্বিমত পোষণ করার বেশি কাউকে পাওয়া যাবে না। সঙ্গে জানিয়ে রাখা ভালো, শেষ বিকেল স্বাগতিকরা ২ উইকেট হারিয়ে কিছুটা ব্যাকফুটেই রয়েছে। লিড কেবল ২১ রানের।
টেস্ট ক্রিকেটে বরাবরই বাংলাদেশের পারফরম্যান্সে ধারাবাহিকতার ঘাটতি থাকে। শেষ ম্যাচে ব্যাটসম্যানরা যে শৃঙ্খল পারফরম্যান্স করেছিল, আজ তা রীতিমত ইউটার্ন নিয়েছিল। পাকিস্তানি বোলারদের ক্রেডিট দিতেই হবে। তবে ব্যাটসম্যানদের দায়ও কম নয়। বাঁহাতি ব্যাটসম্যানরা লেগ স্টাম্পের উপরের বল খেলতে গিয়ে উইকেট বিলিয়ে এসেছেন। প্রথমে জাকির, পরে সাদমান। দুই ওপেনারকে অনুসরণ করেন শান্তও। শুরুর তিন বাঁহাতিকেই প্রায় একইরকম ডিলিভারিতে আউট করেন খুররম শাহজাদ। মুমিনুলও একই পথের পথিক। বাঁহাতি পেসার মীর হামজার বলে লোপ্পা ক্যাচ দেন খুররমকে। আগের ম্যাচের নায়ক মুশফিকুর রহিমই দিনের সেরা বলে ড্রেসিংরুমের পথ ধরেন। হামজার বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন।
ব্যাটিং ফর্মহীনতায় থাকা সাকিব আজও আড়ালে। খুররমের চতুর্থ শিকার হন ভেতরে ঢোকানো ডেলিভারিতে। ২৬ রানে ৬ ব্যাটসম্যান সাজঘরে। শেষবার এমন পরিস্থিতি হয়েছিল ডারবানে ২০২২ সালে। সেবার ৫৩ রানে অলআউট হওয়া ইনিংসে বাংলাদেশ ২৬ রানেই ৬ উইকেট হারিয়েছিল। তবে সেবারের মতো এবার ইনিংস বিপর্যয় হয়নি। এবার মিরাজ ও লিটন দলকে টেনে তোলার দায়িত্ব নিয়ে দিনটাকে রঙিন করে তোলেন।
শুরুতে লিটন একটু রয়েশয়ে ছিলেন। মিরাজ প্রতি আক্রমণে যান। থিতু হওয়ার পর লিটনও যোগ দেন আক্রমণে। বলের ধার কমার সঙ্গে সঙ্গে দুজনের ব্যাটের দ্যুতি বাড়তে থাকে। তারপর আর তাদের আটকানো যায়নি। মধ্যাহ্ন বিরতিতে দুজন ফিফটি পেয়ে যান। পরে একই ধারাবাহিকতায় ব্যাটিং করে দুজন দলের রান এগিয়ে নেন। দলের রান দুই’শ ছোঁয়ার আগে ভাঙে এই জুটি। খুররমের লেন্থ বল ড্রাইভ করতে গিয়ে ফিরতি ক্যাচ দেন। তাতে ভেঙে যায় রেকর্ড গড়া জুটি। ১২৪ বলে ১২ চার ও ১ ছক্কায় ৭৮ রানের ইনিংস উপহার দিয়ে যখন সাজঘরে ফেরেন তখন বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে চলে যায়।
তখন শুধু অপেক্ষায় লিটনের সেঞ্চুরির। তাসকিন তাকে সঙ্গ দিতে না পারলেও হাসান মাটি কামড়ে পড়ে ছিলেন। ৫১ বল মোকাবিলা করে লিটনকে সেঞ্চুরির সঙ্গ তো দিয়েছেনই, গুরুত্বপূর্ণ ১৩ রানও যোগ করেন। তাতে প্রথম ইনিংসের পুঁজি খুব কাছাকাছি চলে আসে।
ব্যাটিংয়ের পর বোলিংয়ে এসে তার পকেটে যায় আব্দুল্লাহ শফিক ও খুররম শাহজাদের উইকেট। তাতে স্বপ্নময় দিনের শেষটা আরও রঙিন হয়ে উঠে। দিনের শুরুর গল্প ও শেষ গল্প এক হলো না। পাকিস্তানের বিধ্বংসী সকালের পর প্রতি আক্রমণে গিয়ে লিটন ও মিরাজ যে সুন্দর দিনের ছবি আঁকলেন তাতে বড় আশা নিয়ে দিন শেষ করলো বাংলাদেশ। ম্যাচটা বাংলাদেশ পাকিস্তানের হাতে যেতে দেয়নি সেটাই এখন বড় পাওয়া।