পঁচিশ মাস আগে মেয়েরা যখন সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতলো, তখন উৎসবে মেতে উঠেছিল গোটা দেশ। সানজিদা আক্তারের একটি পোস্টে বদলে যায় দৃশ্যপট। তার আবদার ছিল ছাদখোলা বাসে তাদের বিমানবন্দর থেকে যেন নিয়ে আসা হয়।
এরপর অল্প সময়ের ব্যবধানে তৈরি করা হয় ছাদখোলা বাস। বিমানবন্দর থেকে ভিক্টরি প্যারেড করতে করতে তাদের নিয়ে আসা হয় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন ভবনে, তাদের আবাসিক ফ্লোরে।
সেই সময় চ্যাম্পিয়নের রেশ থাকতে থাকতে প্রচুর পুরস্কারের ঘোষণা আসে। তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী তাদের সংবর্ধনা দেন। সেখানে প্রত্যেক খেলোয়াড়কে ৫ লাখ টাকা করে দেওয়া হয়। বাফুফের সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী ও সহ-সভাপতি আতাউর রহমান ভূইয়া মানিক ৫০ লাখ টাকা দিয়েছিলেন ফুটবল দলকে। এছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পুরস্কার পায় সাবিনা-কৃষ্ণারা।
তখন মনে করা হয়েছিল পাল্টে যাবে বাংলাদেশের নারী ফুটবলের চিত্র। কিন্তু পরিস্থিতি উল্টে যেতে বেশি সময় নেয়নি। যেখানে নারী ফুটবলারদের ভাগ্যের চাকা বদলে যাওয়ার কথা সেখানে ছুটেছিল উল্টোরথে।
চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি আর্থিক পুরস্কার দেওয়ার কথা থাকলেও অনেকে দেননি। আবার যারা দিয়েছেন তাদেরটা ঠিকমতো পাননি নারী ফুটবলাররা।
এরপর যদিও ফুটলারদের বেতন কাঠামো তৈরি করা হয়। সেখানে জায়গা পান ৩১ জন ফুটবলার। তাদের মধ্যে ১৫ জনের মাসিক বেতন ধরা হয়েছিল ৫০ হাজার করে। আর ১৬ জনের বেতন ধরা হয়েছিল ৩০ থেকে ১০ হাজার টাকা করে। কিন্তু এই বেতনটাও তারা ঠিকমতো পায়নি। সবশেষ তিন মাসের বেতন তাদের বকেয়া রয়েছে এখনও।
মেয়েদের চাওয়া অবশ্য বেশি নয়। নিয়মিত বেতন, নিয়মিত লিগ আয়োজন, এশিয়ান পর্যায়ে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ এবং বিদেশি লিগে খেলার অনুমতি। ২০২২ সাফ জয়ের পর এক বছর ঘরোয়া লিগ ভালো হলেও এ বছর ছিল যাচ্ছেতাই। যেখানে বড় কোনো দল অংশ নেয়নি। উঠে আসেনি কোনো প্রতিভা। মেয়েদের লিগে এখনও পেশাদারিত্বের কোনো ছাপ রাখতে পারেনি বাফুফে। এশিয়ান পর্যায়ে কোনো টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়নি সাবিনা-সানজিদারা। এমনকি মেয়েদের বিদেশি লিগে খেলারও অনুমতি দেওয়া হয়নি এবার।
২০২৪ নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে যাওয়ার আগে তাদের দুর্দশা ছিল অবর্ণনীয়। প্রতিদিন নিয়ম করে অনুশীলন করলেও ভালো খাবার পাননি ফুটবলাররা। বাজারের সবচেয়ে কমদামি পাঙ্গাস মাছ জুটেছিল তাদের পাতে। আর বাফুফের চতুর্থ তলায় এক রুমে ৭ জন গাদাগাদি করে থেকেছেন পুরো ক্যাম্প চলাকালিন সময়ে।
তারপরও নিজেদের সামর্থের সবটুকু নিংড়ে দিয়ে ভারত, নেপালের মতো শক্তিশালী দলকে হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতে মেয়েরা। নিজেদের সামর্থ ও সক্ষমতা প্রমাণ করে। তাতে আবারও আনন্দে ভাসছে গোটা দেশ। আবারও আসছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি থেকে আর্থিক পুরস্কারের ঘোষণা।
এমন সময় আবারও সেই পুরনো প্রশ্ন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে বাধা ডিঙিয়ে এনে দেওয়া বিজয় আবার কি হবে ম্লান; বৈষম্য, সুযোগ-সুবিধার অভাব আর সীমাবন্ধতার বেড়াজালে? আবারও কি মেয়েরা যেই তিমিরে ছিলেন সেখানেই রয়ে যাবেন?
বৃহস্পতিবার (৩১ অক্টোবর) ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াকে নারী ফুটবল দলের বৈষম্য নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। তিনি জবাবে বলেছিলেন, ‘আপনারা জানেন কিছু অভিযোগ আছে। বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল ও বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের ব্যাপারে কিছু বৈষম্য এবং সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে কিছু অভিযোগ আছে। আমরা সেগুলো জেনেছি এবং সেই বিষয়গুলোকে অ্যাডজাস্ট করার জন্য ইতোমধ্যেই বাফুফের সঙ্গে কথা বলেছি। বিসিবির সাথেও কথা বলেছি। এই সমস্যাগুলো আমরা দ্রুতই সমাধান করতে পারবো বলে আশা রাখছি।’
বেতন বকেয়া পড়ার বিষয়টিকে দুঃখজনক উল্লেখ করে বাফুফের নব-নির্বাচিত সিনিয়র সহ-সভাপতি ইমরুল হাসান বলেছেন, ‘গত বছর থেকে মেয়েরা বেতন কাঠামোতে এসেছে। এই বেতনটি অনিয়মত রয়েছে। আমরা দ্রুতই বকেয়া বেতন পরিশোধ করব এবং সামনে আর কোনো বেতন বকেয়া পড়বে না সেভাবে কাজ করব। বিগত সময়েও বেতন বকেয়া পড়াটা দুঃখজনক।’
প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব মো. শফিকুল আলম এক বিফ্রিংয়ে বলেছিলেন, ‘সাফ নারী ফুটবল টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের চ্যাম্পিয়ন হওয়া নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদে আলোচনা হয়েছে। বিভিন্ন মিডিয়ায় নারী ফুটবল দলের বেতন বকেয়া থাকার বিষয়টি উঠে এসেছে। সেটি সালাউদ্দিনের আমলের সমস্যা। তাদের বেতনের সমস্যা দ্রুত সময়ে সমাধান করা হবে।’
ব্যাক টু ব্যাক সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জেতা সাবিনা-মারিয়া-রিতুপর্ণা-রুপনা-তহুরাদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে আরও অগনতি মেয়েরা স্বপ্ন দেখবেন ফুটবলার হওয়ার। জাতীয় দলে খেলার। বাংলাদেশের লাল-সবুজের জার্সি পরে বড় বড় টুর্নামেন্টের শিরোপা জেতার। বিদেশের মাটিতে বারবার দেশের পতাকা উড়ানোর।
তারা যেন এসে না দেখেন যে, মেয়েরা ঠিকমতো বেতন পান না। ঠিকমতো খেতে পান না। ঠিকমতো আবাসন পান না। শিকার হন নানা বৈষম্যের।
শত বৈষম্য আর সীমাবদ্ধতার বেড়াজাল ডিঙিয়ে বাংলাদেশের নারী ফুটবল পৌঁছে যাক নতুন গন্তব্যে।