‘নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ-২০২৪’ জয়ী দলের খেলোয়াড় নিলুফা ইয়াসমিন নীলা। হতদরিদ্র, অবহেলা ও চরম হতাশা নিয়ে বেড়ে উঠেছেন এই নারী খেলোয়াড়। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করে নিলুফা এখন রীতিমতো কুষ্টিয়াবাসীর গর্বে পরিণত হয়েছে। ক্রীড়াঙ্গনে সাফল্য দেখানো কুষ্টিয়ার য়ারও অনেকের সঙ্গে নিলুফার নামও উচ্চারিত হচ্ছে কুষ্টিয়াবাসীর মুখে।
কুষ্টিয়ার হতদরিদ্র এক পরিবার থেকে উঠে এসেছেন নিলুফা। ছোটবেলায় রিকশাচালক বাবা ছেড়ে যান পরিবার। মা আগলে রাখেন নিলুফাকে। তার বয়স তখন মাত্র আড়াই বছর ও ছোট বোন সুরভী আক্তারের বয়স দেড় মাস। মা বাছিরন আক্তার দুই মেয়ে নিয়ে চোখেমুখে অন্ধকার দেখেন। আশ্রয় নেন কুষ্টিয়া শহরের থানাপাড়া এলাকার কুঠিপাড়া চরে বাবার বাড়িতে। তিনি শহরের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সামান্য বেতনে চাকরিও শুরু করেন।
মায়ের ইচ্ছে ছিলো মেয়ে দুটোকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবেন। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলায় পারদর্শী ছিলেন নিলুফা। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই নানা খেলায় সাফল্য দেখানো শুরু করেন। উচ্চ লাফ, দৌড়সহ প্রায় সব ধরনের খেলায় মেয়ের পারদর্শীতা দেখে মা বাছিরন আক্তার মেয়েকে ক্রীড়াবিদ হিসেবে তৈরির ইচ্ছা পোষণ করেন।
তিনি মেয়েকে উৎসাহ ও সাহস দিতে থাকেন। তবে চিরাচরিত বাঙালি সমাজের কুসংস্কারাচ্ছন্নতা ঘিরে ধরেছিল। তার পরিবারকে নানা নেতিবাচক কথাও শুনতে হয়েছে। তবে থেমে থাকেননি নিলুফা। খেলাধুলার পাশাপাশি চালিয়ে যান পড়ালেখা। কুষ্টিয়া শহরের চাঁদ সুলতানা স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করার পর মিরপুর উপজেলার আমলা সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন নিলুফা। পরে খেলোয়াড় কোটায় ভর্তি হন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ফুটবলে সাফল্য দেখানো নিলুফা প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে অর্থ পুরস্কারও পেয়েছেন। সেই অর্থ দিয়ে জমি কিনে জুগিয়া ফার্মপাড়ায় বাড়ি তৈরির কাজ শুরু করেছেন। বর্তমানে কুষ্টিয়া পৌরসভার জুগিয়া এলাকায় বসবাসরত নিলুফার মা বাছিরন আক্তার বলেন, ‘আমার মেয়ে জাতীয় দলে ফুটবলার এ কথা এলাকার অনেকেই জানতেন না। এমনকি শহরেরও অনেকে জানতো না। সেই নিলুফা এখন সবার গর্ব। আমার মেয়ে এখন দেশের জন্য খেলাধুলা করে। এর চেয়ে গর্বের বিষয় একটা মায়ের কাছে আর কি হতে পারে।’
বাছিরন আক্তার আরো বলেন, ‘সংসারে অভাব-অনটন ছিল। অভাবে কষ্টে মানুষ করেছি। নিলুফা যদি কোনোদিক থেকে ভালো করতে পারে করুক। বাধা দেবো না। মানুষ যত খারাপ বলে বলুক, শেষ দেখে ছাড়বো। আমি চাই সে আরো ভালো কিছু করে দেশের সুনাম আরো বৃদ্ধি করুক।’
নিলুফা বর্তমানে ঢাকায় দলের সঙ্গে অবস্থান করেছেন। ছুটি পেলেই বাড়ি ফিরবেন। আর মেয়ের জন্য পথ চেয়ে আছেন মা বাছিরন আক্তার। নিলুফার ছোট বোন সুরভী আক্তারেরও যেন তর সইছে না।
নিলুফার নানী রোকেয়া বেগম বলেন, ‘আমরাসহ সারা বাংলাদেশের মানুষ নীলার জন্য খুশি। এলাকার ছোটরা আনন্দ করে বেড়াচ্ছে। প্রথমে অনেকেই অনেক বাধা দেয়। ওর খেলাধুলায় যখন আগ্রহ দেখি তখন আমি আর ওর মা ওকে সাপোর্ট করতাম। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলার আগ্রহ ছোটবেলা থেকেই। এতদুর এসেছে নীলা, আমরা চাই দেশের জন্য সবসময় খেলাধুলা করুক। সে আমাদের দেশের সম্পদ। দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই।’
যুগীয়া গ্রামের বাসিন্দা কুষ্টিয়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সচিব আব্দুর রহিম বলেন, ‘নিলুফা ইয়াসমিন নিলা আমাদের এলাকার মেয়ে। আমরা ওর জন্য গর্ববোধ করছি। নিলুফার মা বাছিরন আক্তার খুব কষ্ট করে ওদের দুইবোনকে মানুষ করছে। নীলা গ্রামে ফিরলে আমরা সংবর্ধনা দেবো।’
গত বুধবার (৩০ অক্টোবর) রাতে কাঠমুন্ডুর দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ফাইনালে নেপালকে ২-১ গোলে হারিয়ে ‘নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ-২০২৪’ সালের আসরে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। সেই দলের অংশ ছিলেন নিলুফারও।