ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার সন্দেহে গ্রেপ্তার করা হয়েছে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুকে। গত ২৫ মে তিনি সংসদ সদস্যের ছোট মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিনের পাশে দাঁড়িয়ে আনার হত্যার বিচার চান। হত্যায় গ্রেপ্তার ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ বিষয়ক সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবুও সেসময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
আরও পড়ুন: আ.লীগ নেতা গ্যাস বাবুর দোষ স্বীকার
সংসদ সদস্য আনার হত্যা মামলায় সাইদুল করিম মিন্টুকে গত ১১ জুন ঢাকার ধানমন্ডি এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। গত বৃহস্পতিবার তাকে ১০ দিনের রিমান্ডে চেয়ে আবেদন করে ডিবি পুলিশ। পরে আদালত ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ঢাকার অ্যাডিশনাল চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেন শুনানি শেষে রিমান্ডের আদেশ দেন।
এর আগে গত ৭ জুন ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবুকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। তিনি এ হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দিও দিয়েছেন আদালতে।
আরও পড়ুন: আ.লীগ নেতা মিন্টুকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন: ডিবি
আনার হত্যাকাণ্ডে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু জড়িত এমন অভিযোগ ওঠার পর হতাশ হয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। জেলার শীর্ষ পদধারী ব্যক্তি দলের একজন সংসদ সদস্যকে হত্যায় জড়িত হবেন সেটি মেনে নিতে পারছেন না অনেকেই।
আনার অনুসারীরা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত সবার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। সাইদুল করিম মিন্টুকে দল থেকে বহিষ্কারের দাবিও জানান তারা। প্রতিদিনই ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন করছে আনারের অনুসারীরা।
আরও পড়ুন: আদালতে যা বললেন সাইদুল করিম মিন্টু
এদিকে, সাইদুল করিম মিন্টুর মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন করছে তার অনুসারীরা। তবে, এসব মানববন্ধনে জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ পদধারীদের দেখা যাচ্ছে না।
জানা গেছে, গত ২২ মে সংসদ সদস্য আনার ভারতের কলকাতার নিউটাউন এলাকার সঞ্জীবা গার্ডেনে খুন হওয়ার খবরে তার পরিবারের সদস্যরা শোকর্ত হয়ে পড়েন। তাদের সমবেদনা জানাতে ছুটে আসেন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। তারই ধারাবাহিকতায় ২৫ মে আনারের পরিবার ও নেতাকর্মীদের সমবেদনা জানাতে যান ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু। কালীগঞ্জ শহরের ভূষণ স্কুল সড়কে আনারের বাসভবনের নিচে বসে তিনি কথাও বলেন। এসময় আনার হত্যায় আটক ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ বিষয়ক সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবুও উপস্থিত ছিলেন।
আরও পড়ুন: আনার হত্যায় আর্থিক লেনদেনে মিন্টু জড়িত: ডিবি পুলিশ
সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের ছোট মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিনের সঙ্গে কথা বলে উপস্থিত সাংবাদিকদের সাইদুল করিম মিন্টু বলেন, ‘আনার যে ভালো কাজগুলো করেছে সেটি তুলে ধরেন। শুধু নেগেটিভ নিউজ করবেন না। প্রধানমন্ত্রী এই বিষয়টি দেখভাল করছেন। ভারত থেকে আনারের দেহাংশ এলেই আমরা দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করে দলীয় কর্মসূচি দেবো।’
তিনি আরো বলেন, ‘এমপি হওয়ার আগে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিল আনার। আওয়ামী লীগ শাসনামলের ১৫ বছরে প্রায় ৫ হাজার মানুষের জানাজা পড়েছে আনার।’ সেসময় এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের ডিবি পুলিশ খুবই কার্যকরী সংস্থা। আমরা বিশ্বাস করি যত ক্ষমতাবান লোক হোক ডিবি তাদের গ্রেপ্তারে সক্ষম হবে। আর তখনই সঠিক তথ্যটি উদঘাটন হবে। তাছাড়া, যারা গ্রেপ্তার হয়েছে তাদের রিমান্ডে নিয়েছে। রিমান্ডে অনেক কথা বের হয়।’
আরও পড়ুন: ঝিনাইদহ আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক মিন্টু ৮ দিনের রিমান্ডে
আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, ‘এমপি আনার হত্যায় নেপথ্যে কারা, প্রকাশ্যে কারা সবই বেরিয়ে আসবে। কারা মদদদাতা, কারা যোগানদাতা সবই বেরিয়ে আসবে। এই আসনে আমরা অনেকেই মনোনয়ন চেয়েছিলাম। তাকেই বারবার দেওয়া হচ্ছে। এই আসনে তার (আনার) জনপ্রিয়তা আছে বলেই দেওয়া হয়েছে।’
সাইদুল করিম মিন্টু বলেন, ‘বিভিন্ন মিডিয়ায় যেসব তথ্য দিয়ে নিউজ করা হচ্ছে এটা খুবই কষ্টদায়ক। যারা স্বজন হারায়নি তারা বুঝতে পারবে না। আমার মা-বাবা নেই, আমি বুঝতে পারছি এই কষ্ট। এই হত্যার সঙ্গে জড়িত তাদের দৃৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’
আরও পড়ুন: এমপি আনার হত্যা: আ.লীগ নেতা ‘গ্যাস বাবু’ আটক
এমপি আনারের অনুসারী কালীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আশরাফুল আলম বলেন, ‘জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু আমাদের দলের অভিভাবক। তার হাতে যদি সংসদ সদস্য আনার নিরাপদ না হন, তাহলে সাধারণ নেতাকর্মী কেউই নিরাপদ নয়। ডিবি পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে ৮ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে। তিনি সত্যিই যদি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হন, তাহলে তার ফাঁসি ও দল থেকে বহিষ্কারের দাবি জানাচ্ছি।’
এই হত্যাকাণ্ডে কালীগঞ্জের কিছু নেতা মিন্টুকে অর্থের যোগান দিয়েছেন বলেও দাবি করেন এই নেতা।
আরও পুড়ন: সাইদুলকে আটকের প্রতিবাদে ঝিনাইদহে মিছিল
কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের সভাপতি শিবলী নোমানী বলেন, ‘জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু গত ২৫ মে এমপি আনারের বাসায় এসেছিলেন। এসময় আমিও উপস্থিত ছিলাম। সাইদুল করিম মিন্টুর সঙ্গে জেলা ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবুও ছিলেন। সংসদ সদস্য আনার হত্যায় তার জড়িত থাকার তথ্য মিলেছে। এটা আসলে খুবই দুঃখজনক। আমরা জেনেছি, আনার হত্যার অর্থের যোগানদাতা ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু।’
উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর সিদ্দিকী ঠান্ডু বলেন, ‘আস্তে আস্তে থলের বিড়াল বের হতে শুরু করেছে। সাইদুল করিম মিন্টুই আওয়ামী লীগকে শেষ করে রেখে গেলো। একজন নেতার কাছে যদি কর্মী নিরাপদ না হয়, তাহলে আমরা কোথায় যাবো। যেদিন ডরিনের সঙ্গে দেখা করতে আসেন সেদিন মিন্টু আমার সঙ্গেও দীর্ঘক্ষণ কথা বলেন। তিনি দলীয়ভাবে কর্মসূচি ঘোষণার কথাও বলেন। আজ দৃশ্যপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি নিজেই এই হত্যার সঙ্গে জড়িত।’
আরও পড়ুন: সাইদুলকে আটকের খবরে কালীগঞ্জে আনন্দ মিছিল
সাইদুল করিম মিন্টুর অনুসারী জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আল-ইমরান বলেন, ‘জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু রাজনৈতিক প্রতিহিংসার স্বীকার। তাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। আমরা তীব্র নিন্দা জানায়।’
এ ব্যাপারে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিকুল ইসলাম অপু বলেন, ‘কেউ আইনের উর্ধ্বে নয়। সংসদ সদস্য আনার হত্যায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’
প্রসঙ্গত, গত ১২ মে চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়ে নিখোঁজ হন ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার। এরপর গত ২২ মে ভারতের কলকাতার নিউটাউন এলাকার সঞ্জীবা গার্ডেন নামে একটি আবাসিক ভবনে সংসদ সদস্য আনার হত্যার শিকার হন। পরে মরদেহ টুকরো টুকরো করে বিভিন্ন স্থানে ফেলে দেয় হত্যাকারীরা। এ ঘটনায় ভারত ও বাংলাদেশে অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।