সারা বাংলা

‘পানিতো কমে গেছে, আমার যে ক্ষতি কোনোভাবে পুষাবে না’

‘পরনের কাপড় ছাড়া আর কিছুই নিয়ে আসতে পারিনি। এখন কিছুই তো নাই। সব পানি নিয়ে গেছে। কেবল আমরাই বেঁচে আসছি। কী কইমু, আমি তো একেবারে নিঃস্ব হইয়া গেছি। ঘর, জিনিসপত্র সব ভাসাইয়া নিছে পানি। ঘরে যা ছিল তা ১১ দিনের পানিতে পচে গেছে। পানিতো কমে গেছে, আমার যে ক্ষতি, তা তো কোনোভাবে পুষাবে না।’ এভাবেই নিজের অনুভূতি প্রকাশ করছিলেন বন্যায় সহায়-সম্বল হারানো কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ইন্দ্রবতী গ্রামে ধীরেন্দ্র চন্দ্র দাস।

বন্যায় ভেঙে ধীরেন্দ্র চন্দ্র দাসের মাটির ঘর। বানের তোরে মাটির ঘর মিশে গেছে মাটিতে। ঘর হারিয়ে রীরেন্দ্র দাসের এখন শেষ সম্বল খালি ভিটা। 

ছেলের বউ আর দুই নাতিনকে নিয়ে ভিটার ওপর দাঁড়িয়ে নতুন ঘর করার দুশ্চিন্তায় রয়েছেন ধীরেন্দ্র চন্দ্র দাস। ছেলে বিশ্বজিৎ বিদেশে থাকলেও সেখানে তিনি বেকার হওয়ায় পরিবারটির ঘর তৈরি করা নিয়ে তৈরি হয়েছে সংকট। একই অবস্থা কুমিল্লা চৌদ্দগ্রাম উপজেলার কনকাপৈত ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামে বাসিন্দা রহিমা আক্তারের।

রহিমা আক্তার বলেন, ‘ডাকাতিয়া নদীর পানি নামতে শুরু করায় আমাদের বাড়ির পানিও নামতে শুরু করছে। তাই আশ্রয়কেন্দ্র থেকে আজ সোমবার (২ সেপ্টেম্বর) ঘরে ফিরেছি। ক্ষতিগ্রস্ত ঘর দেখে আঁতকে উঠেছি। বন্যা পানিতে ভেসে গেছে বাড়ির সামনে পুকুরের মাছ। রান্না করার চুলাও ভাসিয়ে নিয়ে গেছে পানি। এতদিন তো মানুষের ত্রাণে চলেছি। এখন  কীভাবে চলবো। জীবনের শেষ সম্বল টুকু হারিয়ে রাস্তায় বসা ছাড়া আর কোন উপায় দেখতেছি না।’

সোমবার ( ২ সেপ্টেম্বর)  কুমিল্লা জেলার বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়া, চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বিভিন্ন বন্যা আক্রান্ত এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, ঘরবাড়ি, স্থাপনা বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে আছে। কিছু ঘরের চাল উড়ে গেছে। কিছু ঘরের টিন থাকলেও চারপাশের বেড়া- মাটির দেয়াল ধসে পড়েছে। পুকুর-মাছের ঘের জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বের হয়ে গেছে চাষের মাছ। মরে গেছে অসংখ্য খামারের মুরগি। 

গোমতি চরের বাসিন্দারা বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকটে পড়েছেন। অনেক টিউবওয়েল জোয়ারের পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। এক বেলা খাবার খাবেন সেই পরিস্থিতিও নেই অনেকের। পানির তোড়ে ভেঙে গেছে গ্রামের মেঠো পথ। ফলে মানুষের স্বাভাবিক চলাচলেও বাধা তৈরি হয়েছে। পুঁজি হারিয়ে এখন নিঃস্ব হাজারো পরিবার। 

জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, জেলায় ১৭টি উপজেলায় বন্যায় আক্রান্ত ১৪টি উপজেলার ১২৬ টি ইউনিয়নের প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।প্রাণিসম্পদের ক্ষতি হয়েছে ৩০৮ কোটি টাকার, মৎস্য খাতে ক্ষতি হয়েছে ৫০০ কোটি টাকার। কৃষি খাতে ৮৪৮ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। অবকাঠামো, সড়কসহ বিভিন্ন খাতে ১৪০০ কোটি টাকা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ১৪ উপজেলায় ঘর-বাড়ি হারিয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার পরিবার। সবচেয়ে বেশি বুড়িচং উপজেলার ৪০ হাজার পরিবার ঘর বাড়ি হারিয়েছেন।

কুমিল্লা জেলা দুর্যোগ ও ত্রাণ কর্মকর্তা আবেদ আলী বলেন, জেলায় ১০ লাখ ৭৮ হাজার মানুষ পানিবন্দি ছিলেন। ৭২৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৭৮ হাজারেরও বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন। জেলা প্রশাসন থেকে ৩৯ লাখ নগদ টাকা ও ৮০০ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কুমিল্লা জেলায় ১৬০০ টন চাল, নগদ ২৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।

এ দিকে কুমিল্লায় পর্যাপ্ত ত্রাণ এসেছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। বিভিন্ন সংগঠন ও শিক্ষার্থীরা ত্রাণ দুর্গতদের মাঝে পৌছে দিচ্ছেন বলেও জানানো হয়েছে।

কুমিল্লার জেলা প্রশাসক খন্দকার ম মুশফিকুর রহমান বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। আমরা আমাদের প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করছি বন্যাদুর্গতদের।